সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

হাতিয়ার ঢালচরে বহিরাগতদের দখলদারি, দিশেহারা ভূমিহীন বাসিন্দারা

ছায়েদ আহামেদ, হাতিয়া (নোয়াখালী)
প্রকাশিত: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৫০ পিএম

শেয়ার করুন:

হাতিয়ার ঢালচরে বহিরাগতদের দখলদারি, দিশেহারা ভূমিহীন বাসিন্দারা

দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার একপ্রান্তে ভাঙন আর অপর প্রান্তে মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চরে মাথাগোঁজার ঠাঁই নেন ভূমিহীন উদ্বাস্তু মানুষেরা। গৃহহীন হয়ে স্থানীয় যেসব চরে আশ্রয় নেন তার একটি হচ্ছে ঢালচর। প্রায় শতবছর ধরে এ চরে বাস করে আসলেও কখনও স্বস্তির সঙ্গে এ মাটিকে আলিঙ্গন করতে পারেননি চরবাসী। প্রতিমুহূর্তে লড়াই করতে হচ্ছে পার্শ্ববর্তী মনপুরা উপজেলার দখলদার ভূমিদস্যুদের সঙ্গে।

thumbnail_IMG20241231132806


বিজ্ঞাপন


নোয়াখালী ও ভোলার মাঝামাঝি মেঘনার বুকে জেগে ওঠা এ চরে প্রশাসনের সরাসরি তদারকি না থাকায় এখানকার নিয়মকানুন চলে দখলদার প্রভাবশালীদের ইশারায়।

thumbnail_IMG20241230185251

জানা গেছে, ১৯৪০ সালের দিকে জেগে ওঠা এ চরটি ছিল পুরোপুরি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলাধীন। চরটির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে পলি জমে ভোলা জেলার মনপুরা থেকে দূরত্ব কমে যাওয়ায় চরের দাবি শুরু করে তারা। মনপুরা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন চৌধুরী ও তার ভাতিজা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বিভিন্ন অপকৌশলে মালিকানা দাবি করে ঢালচরের বিশাল অংশ নিজেদের কর্তৃত্বে রেখেছেন। যেমনটি পূর্বে করেছিলেন তাদের বাপ-দাদারাও। আর এদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এবং হাতিয়ার ভূমিহীনদের পক্ষে তখন অবস্থান নিয়েছিলেন প্রয়াত আজহার উদ্দিন মিয়া।

সম্প্রতি প্রতিবেদক সরেজমিনে ঢালচর ঘুরে এর অতীত-বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ জানার চেষ্টা করেন। এসময় মনপুরার ভূমি খেকোদের হামলায় ১৯৬৯ সালে ঢালচরের আহত বৃদ্ধ ভূমিহীন সারু মিয়াসহ একাধিক ভূমিহীন জানান, মনপুরার দখলদাররা হামলা করে হাতিয়ার ঢালচরের ২২ জন ভূমিহীনকে হত্যা করে এবং ওইসব হামলায় ৪১ আহত হয়। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সেই কালপরিক্রমা এখনও চলমান। ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর রাতে স্থানীয় ঝর্ণা বেগমের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে সব ছাই করে ফেলেছে। গরু, ভেড়া, ছাগলসহ ঘরের মূল্যবান সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে মনপুরার ভূমি খেকোরা। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ঝর্ণা বেগম বাদী হয়ে মনপুরার ইউনুছনাজির ও ফয়েজ উল্যাহসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে ১৫ ডিসেম্বর হাতিয়া থানায় মামলা করেন। ঢালচরের দক্ষিণাংশে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও তার পরিবারবর্গের গরুর খামার, চিংড়ি প্রজেক্টসহ প্রায় ২৩টি খামার রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।


বিজ্ঞাপন


thumbnail_Screenshot_2024-12-17-21-33-17-47_e5d3893ac03954c6bb675ef2555b879b

বিগত সরকারের প্রভাব খাটিয়ে হাতিয়ার ঢালচরকে চর ডেমপিয়ার নামে আদালতের একতরফা রায় নেওয়া ও সাম্প্রতিক ভূমিহীনের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুট সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীকে কল দিলে তিনি জানান, এসব বিষয়ে মোবাইল ফোনে তিনি কথা বলতে রাজি নয়।

thumbnail_IMG20241217124352

এর আগে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল জরিপ কর্মসূচির নাম করে ঢালচরের মাঝামাঝি স্থানে জিওডেটিক পিলার স্থাপনের নামে ঢালচরবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষ বাধান। এ ঘটনায় কানুনগো জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মনপুরা থানায় ভূমিহীন নেতা ইকবাল মিয়াসহ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। জানা যায়, এ চরটির বিষয়ে ১৯৬০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বোর্ড অব রেভিনিউর অতিরিক্ত সচিব এন আহমেদ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের পরিচালককে এক অফিস আদেশে লিখেছেন, ঢালচর নোয়াখালী জেলার সীমানায় নতুন জেগে ওঠা একটি চর এবং এটি নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মনপুরা বাকেরগঞ্জ (ব্রিটিশ ভারতের প্রাক্তন জেলা) জেলার একটি থানা। তিনি নোয়াখালী ও তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার মধ্যে সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে এই অফিস আদেশ জারি করেন।

thumbnail_IMG20241217112408

একই বছরের ১১ মে পূর্ব পাকিস্তান বোর্ড অব রেভিনিউর সদস্য (বিশেষ) এস বি হ্যাচ বার্নওয়াল এক অফিস আদেশে ঢালচর সম্পর্কে বলেন, এটি নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত একটি নতুন চর। একই অফিস আদেশে নোয়াখালী জেলা কালেক্টরের পক্ষ থেকে ঢালচরে সেটেলমেন্ট কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬০-৬১ সালে ঢালচর ৫১ নম্বর তৌজি (কালেক্টরেটে যে রেজিস্ট্রার সংরক্ষিত থাকে) হিসাবে এক হাজার ১৫৩টি বন্দোবস্ত নথির প্রত্যেক বন্দোবস্তের অনুকূলে ২.৫০ একর জমি জমাবন্দি করা হয়। ৪৪৬ জন বন্দোবস্তকারীর কাছ হতে কবুলিয়াত গ্রহণ করা হয়। তার এমন আদেশের বিরুদ্ধে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার জমিদার রাজেশ কান্ত রায় বরিশালের দ্বিতীয় সাব জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করে এতে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দাবি করলে আদালত ১৯৬০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ঢালচরে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

thumbnail_IMG20241217123919

১৯৮৭ সালের ২১ মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. ইনামুল হকের সভাপতিত্বে আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণ বিষয়ক এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, নোয়াখালী জেলার ১৯১৩-১৬ সালের সিএস জরিপের রেখা ও ভোলা জেলার ১৯৪০-৪২ ও ১৯৪৫-৫২ সালের আরএস জরিপের রেখার মধ্যবর্তী রেখাই নোয়াখালী ও ভোলা জেলার সীমানারেখা হবে। একই সিদ্ধান্তের ওপর ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ ভূমি মন্ত্রণালয়ের শাখা-২ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক সরকারের এলজিইডি, ইউএনডিপি/ল্যান্ড প্রজেক্টের আওতায় ৯৪ সালে প্রণীত থানা নকশায় সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়, ঢালচর সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত।

thumbnail_IMG20241231100925

২০০৮ সালের ৮ জুলাই নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবদুল হক ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে- ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৯৬ সালের ১৬ মার্চের গেজেট বিজ্ঞপ্তি এবং ৬০ সালের পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে অব রেভিনিউর অতিরিক্ত সচিবের জারিকৃত পত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী দুই জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সভা করে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর কর্তৃক নোয়াখালী (হাতিয়া) ও ভোলার (মনপুরা) আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণ করে দীর্ঘদিনের বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কাছে হেরে নোয়াখালী ও ভোলা জেলার চলমান সীমানা বিরোধ নিয়ে ২০১০ সালে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী তার লোক দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলা দায়ের করেন বলে চরবাসী অভিযোগ করেন। রিটে আসামি বা সরকার পক্ষের কাছে নোটিশের কোনও কাগজপত্র পৌঁছানো হয়নি বলেও অভিযোগ ছিল তৎকালীন নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমানের কাছে। এতে ওই বছরের ৯ আগস্ট বাদীদের অনুকূলে একতরফা রায় হয় ঢালচর ওরপে চর ডাম্পিয়ার নামে।

thumbnail_IMG20241217112408

২০১৬ সালে আদালতের এক নির্দেশে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর নোয়াখালী-ভোলা আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণের জন্য জরিপ কাজ শেষ করে এক স্মারকপত্র জারি করে। অধিদফতরের পরিচালক (জরিপ) আনোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত ওই স্মারকপত্র অনুযায়ী ঢালচর শতভাগ নোয়াখালীর সীমানায় রয়েছে। এদিকে হাতিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ড বইয়ে দেখা যায়, ১৯৯৯-২০০০ সালের ঢালচর ৫১ নম্বর তৌজি হিসাবে ৬ হাজার নথি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। যেখানে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার পরিবার বসবাস করছে। ৫ থেকে ১০ বছরের শিশু রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন। এখানে নেই কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। অথচ সীমানা জরিপের মারপ্যাঁচ খাটিয়ে নাজিমউদ্দীন চৌধুরী ঢালচরের যে দক্ষিণাংশ নিজ কর্তৃত্বে রেখেছেন সেখানে তাদের মাত্র ৭০টি রায়ত পরিবারের জন্য ক্লিনিক, স্কুল, পশুচিকিৎসালয় এবং দু’টি মুজিব কিল্লাসহ বিগত সরকারকারের সব সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ঢালচরের বাসিন্দারা। এখন মনপুরার পাশাপাশি রামগতির সন্ত্রাসী ফখরুল ইসলাম তার গ্যাংদের নিয়ে প্রায় চরবাসীদের থেকে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে বলে জানান ঢালচরবাসী।

thumbnail_IMG20241230170810

এসব বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মং এছেন বলেন, হাতিয়া উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড ঢালচর মৌজায় বিদ্যমান আন্তঃজেলা সীমানা বিরোধ এবং সাম্প্রতিক উদ্ভব পরিস্থিতি সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব। 

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর