বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

বাঁশখালীর উপকূলীয় বনভূমি দখলে সালমান এফ রহমানের ছেলে!

এম আই খলিল, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১১ এএম

শেয়ার করুন:

বাঁশখালীর উপকূলীয় বনভূমি দখলে সালমান এফ রহমানের ছেলে!
দখলকৃত জায়গা ও আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের বিপুল পরিমাণ বনভূমি অবৈধভাবে দখলে রেখেছেন আওয়ামী লীগের আলোচিত নেতা ও শিল্পপতি সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান। যেখানে সৃজিত বন ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে লবণ মাঠ, চিংড়ি ঘের, এমনকি মাছ চাষের জন্য পুকুরও।

বহু বছর ধরে আইনি লড়াইয়ের পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত জমি উদ্ধারের নির্দেশ দিলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। আদালতের রায় অমান্য করে ভূমি দখল অব্যাহত থাকায় বন বিভাগ জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিলেও মিলছে না কোনো প্রতিকার।


বিজ্ঞাপন


শুক্রবার (৮ নভেম্বর) এমন তথ্য জানান চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের হাতে হাইকোর্টের রায় রয়েছে, কিন্তু আমরা নিজেরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে পারি না। এই কাজ জেলা প্রশাসনের। তাদের আমরা চিঠি দিয়েছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছি না।

বন বিভাগের তথ্যমতে, উপকূলীয় বন বিভাগের বাঁশখালী ছনুয়া রেঞ্জের অধীনে খুদুকখালী মৌজায় ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে কয়েক ধাপে ম্যানগ্রোভ বন সৃজন করা হয়। এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের প্রায় ২০০ একর জমি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে জবরদখল করা হয়।

২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ৮০-৯০ জন লোক বন বিভাগের প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার বাইন ও কেওড়া গাছ কেটে ফেলে এবং ওই জমিতে চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠ তৈরি করে। এই ঘটনায় বাঁশখালী থানায় মামলা দায়ের করা হলেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবে পরিস্থিতির কোনো সমাধান হয়নি।


বিজ্ঞাপন


পরবর্তী সময়ে আসামিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা অমান্য করে সেখানে চিংড়ি ও লবণ চাষ চলতে থাকে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও তার সহযোগীরা জাল বিএস খতিয়ান তৈরি করে ওই এলাকার ৯৯ একর খাসজমি বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানের কাছে বিক্রির জাল খতিয়ান সৃজন করেন।

আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান এস্কর্প হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নয় কোটি ২৫ লাখ টাকায় জমিটি ক্রয় দেখান। তবে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর উপকূলীয় বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন জমির মালিকানা ফিরে পেলেও, এখনো তা প্রভাবশালীদের দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

জমি বিক্রি করে চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও তার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছেন। বর্তমানে হারুনুর রশীদ ১৫০ শতক জমির ওপর পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। তার চাচা ও সাবেক চেয়ারম্যান বশির আহমদের ছেলেরাও জমি দখল করে বাসভবনসহ বিভিন্ন সম্পদ গড়ে তুলেছেন।

আরও পড়ুন

সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকোর অর্থপাচার অনুসন্ধানে সিআইডি

মামলার নথি থেকে জানা গেছে, ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজার ৯০ একর জমি সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ১৯৮৪ সালে বন বিভাগের অধীনে হস্তান্তর করা হয় এবং ১৬ একর জমি রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেখান থেকে ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান ওই মৌজার ৯০ একর জমি নারকেল বাগান করার জন্য ১৯৬৬ সালে ২৫ বছরের ইজারা নেয়। কিন্তু ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে তারা সেখানে লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের তৈরি করে।

BBB

ইজারার শর্ত ভঙ্গের কারণে ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ইজারা বাতিল করে, তবে ইজারাগ্রহীতারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন। পরে ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জেলা প্রশাসনের পক্ষে রায় দিয়ে ইজারা বাতিল ঘোষণা করেন। এরপরও জমি দখলে রেখে সেখানে অবৈধ কার্যক্রম চালিয়েছে ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি মূলত চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের।

২০১৮ সালের ১১ মার্চ চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ জমি পুনরুদ্ধারের জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে একটি চিঠি পাঠায়। এই চিঠিতে ৯৯ একর জমি উদ্ধার করে বন বিভাগের অধীনে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু সাত বছর পরও এই চিঠির কোনো উত্তর মেলেনি। এছাড়া চলতি বছরের ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসন থেকে একটি চিঠি সহকারী কমিশনার (ভূমি), বাঁশখালীকে জমির বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পাঠানো হলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বন বিভাগ জমিগুলো দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। ২৬ আগস্ট বন বিভাগের কর্মীরা দখলকৃত এলাকায় লাল পতাকা উত্তোলন করে জমি দখলমুক্ত ঘোষণা করেন। তবে ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের অনুগতরা সেই লাল পতাকা ছিঁড়ে ফেলে জমি দখল অব্যাহত রাখেন।

আরও পড়ুন

দাড়ি-গোঁফ কামিয়েও গ্রেফতার এড়াতে পারেননি সালমান এফ রহমান

স্থানীয়রা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে এই জমিতে লবণ চাষ এবং বর্ষা মৌসুমে চিংড়ি চাষ করা হয়। স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক চৌধুরী দখলমুক্ত করতে দুই হাজার লোক দিয়ে সহযোগিতার প্রস্তাব দিলেও বন বিভাগের কর্মকর্তারা সেই প্রস্তাবে সাড়া দেননি।

অভিযোগের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। এ অবস্থায়ও তিনি এই বনভূমি দখলসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেইলকে বলেন, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন থেকে আমরা এখনো পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমআইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর