সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ছড়িয়ে পড়া লাম্পি স্কিন (এলএসডি) রোগে আক্রান্ত হয়ে এক মাসে প্রায় অর্ধশতাধিক গরু মারা গেছে। গরু বাঁচাতে পল্লী চিকিৎসকদের দৌরাত্মের চিকিৎসায় বেশি টাকা খরচ করেও গরু বাঁচাতে না পারায় চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন খামারিরা।
খামারি ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত চর্মরোগটি গ্রীষ্মের শেষ ও বর্ষার শুরুর দিকে বছরে দু’বার ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত মশা, মাছি ও বিশেষ পোকার মাধ্যমে গরুর দেহে ভাইরাস ছড়ায়। এছাড়া সংক্রমিত গরুর সঙ্গে খাবার গ্রহণ করলেও এই রোগ ছড়াতে পারে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার তালম পদ্ম পাড়ায় করিম সুপারের ১টি, তালম গ্রামের সোরহাব হোসেনের ২টি, বকুলের ১টি, হাবিব মাস্টারের ১টি, রবিউল করিমের ১টি, আলামিনের ১টি, মোতালেবর ১টি, সেলিম সরকারের ১টি, কালামের ১টি, নামা সিলেট গ্রামের তাহের উদ্দিনের ১টি, দিঘী গ্রামের জহুরুল ইসলামের ২টি, সগুনা গ্রামের মাহবুর হোসেনর ১টি, চরকুশাবাড়ি গ্রামের লিটন আহমদের ১টি, ভাটার পাড়া গ্রামের মজিবুর রহমানের ১টি, রহমত আলীর ১টি, খালকুলা গ্রামের সবের আলীর ১টি, তাড়াশ পৌর এলাকার কৃষক ইউনুস আলীর ১টি, সানোয়ার হোসেনের ১টি, দিঘুরিয়া গ্রামের আউয়াল হোসেনর ১টি, শিবপুর গ্রামের মহন আলীর ১টিসহ উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত হয়ে কৃষক ও খামারিদের কমপক্ষে ৫০টি গবাদি পশু গরু মারা গেছে।
তাড়াশ উপজেলার তালম ইউনিয়নের তালম পদ্ম পাড়া গ্রামের মাদরাসার সুপার মো. করিম হোসেনের বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখা যায়, লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া গরু মাটিতে পুঁতে রাখার জন্য কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাড়ি থেকে দূরে ফাঁকা স্থানে।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা জানান, মাস খানেক ধরে প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক, খামারিদের গরুর লাম্পি স্কিনে আক্রান্তের হার বেড়ে গেছে। তা ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলাজুড়ে। আর গত এক মাসে এ উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত হয়ে কৃষক ও খামারিদের কমপক্ষে ৫০টি গবাদি পশু গরু মারা গেছে। সেইসঙ্গে আক্রান্ত আরও অনেক গরুর চিকিৎসা চলছে। সে চিকিৎসাও ব্যয় বহুল এবং মারা যাওয়া গরুর বেশির ভাগই বাছুর।
তালম গ্রামের কৃষক সোরহাব আলী জানান, প্রথমে তার লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরুর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। খাবারের রুচি কমে আসে। এক সময় আক্রান্ত গরুর জ্বর বেশি হয়ে নাক-মুখ দিয়ে লালা বের হতে থাকে। এরপর গরুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে চামড়ায় গুটি গুটি ক্ষত দেখা দেয়। সে ক্ষত কয়েক দিনে পঁচে গিয়ে তা থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। পাশাপাশি গরুর দুই পায়ের মাঝে বুকের নিচে পানি জমতে ঝুলে পড়ে। আর এভাবে আমার দু’টি গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর আমি ওই দুই গরুর চিকিৎসা করাতে দুই সপ্তাহে পল্লী প্রাণী চিকিৎসকদের ভিজিট ও দামি দামি ওষুধ কিনতে প্রায় ১২ হাজার টাকা ব্যয় করি। তারপরও আমার গরু দু’টি বাঁচাতে পারিনি।
দিঘী গ্রামের আইয়ুব আলী বলেন, ষাঁড় ও বাছুরসহ ছয়টি গরু আছে। এর মধ্যে দু’টি গরুর এলএসডি রোগে সংক্রমিত হয়েছে। মশা ও মাছি থেকে বাঁচতে ২৪ ঘণ্টা মশারি টাঙিয়ে রাখতে হচ্ছে। এখন মোটামুটি সুস্থ হলেও গরুর চামড়ার ওপর গভীর ক্ষত হয়ে আছে।
তাড়াশ পৌর এলাকার কৃষক হাসান আলী, আব্দুল মাকেল, রেজাউল করিমসহ অনেকের অভিযোগ করে বলেন, তাড়াশ উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের উদাসীনতা ও গরু ছাগলসহ গবাদি পশুর অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে উপজেলা এলাকায় পল্লী প্রাণী চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য যারপরনাই বেড়ে গেছে। তারা এখন লাম্পি স্কিনসহ গবাদি পশুর নানা রোগের চিকিৎসায় এন্টিবায়েটিক এবং রেজিস্টার চিকিৎসক ছাড়া লেখা যায় না এমন ওষুধ লিখে ও নিজেই দিয়ে মোটা দাগে খরচ নিয়েও আক্রান্ত গরু, তেমন বাঁচাতে পারছেন না। আর এভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বেশির ভাগ কৃষক ও খামারি। আর লাভবান হচ্ছেন পল্লী প্রাণী চিকিৎসক এমনি অভিযোগ আরো অনেক কৃষক ও খামারির।
বেশির ভাগ লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত গবাদি পশুর ভুক্তভোগী মালিক কৃষক এবং খামারিদের ভাষ্য, উপজেলা প্রাণিসম্পদ ভ্যাটেনারি হাসপাতালে গেলে গরুসহ অনান্য গবাদি পশুর তেমন চিকিৎসা পাই না। আবার পল্লী প্রাণি চিকিৎসকদের কাছে গেলে তারাও দু’একটি ইনজেকশন আর এন্টিবায়েটিক ওষুধ দিয়ে প্রথম বারের হাজার বারোশ টাকা বিল করেন। আর বলেন, চিকিৎসা করেন দেখা যাক কি হয়। এভাবে পল্লী প্রাণী চিকিৎসকদের কাছে লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসায় ব্যয় মেটাতে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ছি বলে মন্তব্য করেন আরেক কৃষক ইসমাইল হোসেন।
চৌড়া গ্রামের পল্লী প্রাণী চিকিৎসক মো. তাইজুল ইসলাম বলেন, লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত তালম গ্রামের নজরুল ইসলাম, কুসুম্বী গ্রামের কুশকার সরকার নামা সিলট গ্রামের রাজুর, বিনোদপুর গ্রামের রব্বানীরসহ আরও অনেক গ্রামের কৃষক ও খামারির লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসা চলছে।
এ প্রসঙ্গে তাড়াশ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ডা. অলিউল ইসলাম গরু মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ ভ্যাটেনারি হাসপাতালে থেকে লাম্পি স্কিনসহ নানা রোগে আক্রান্ত গবাদি পশুর চিকিৎসায় আমরা আন্তরিক। এছাড়া এরই মধ্যে শত শত গরুকে লাম্পি স্কিনের প্রতিষেধক টিকাও দেওয়া হয়েছে। আর লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত গবাদি পশু গরুর মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ প্রতিষেধক টিকা কাজ করলেও ২০/২৫ ভাগ কাজ করবে না। পাশাপাশি পল্লী প্রাণী চিকিৎসকদের দৌরাত্ম বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে শাস্তি দেওয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার এখতিয়ার নাই। তা ছাড়া পল্লী প্রাণী চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে এন্টিবায়েটিক লিখতে পারেন না।
প্রতিনিধি/এসএস