images

রাজনীতি

আশায় আশায় বছর কাটল বিএনপির

বোরহান উদ্দিন

২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:২৮ পিএম

  • সাফল্য নেই এক দফার আন্দোলনে
  • সাজা নিয়ে উদ্বেগে গোটা বছর
  • যুগপৎ আন্দোলনে নতুন মিত্রের খোঁজ
  • দল ছেড়ে যাননি নেতাকর্মীরা

দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে নেতাকর্মীদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সময় আরও বেড়ে গেল। যদিও সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সক্রিয় থাকা বিএনপি এবার দাবি পূরণ নিয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিল। তার বড় কারণ ছিল নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা। বিশেষ করে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী অনেক দেশ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে তৎপর হওয়ায় আশায় বুক বেঁধেছিল বিএনপি ও তাদের নেতাকর্মীরা। কিন্তু আপাতত সেই আশায় গুড়েবালি। কারণ বিদেশিদের তৎপরতায় থেমে থাকেনি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ট্রেন।

অবশ্য নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে মাঠে থাকা দলটির নেতারা আশা করছেন, ভোট করে ফেললেও পরবর্তীতে সরকারকে আন্তর্জাতিক মহলের চাপের মুখে পড়তে হবে। ফলে আওয়ামী লীগ তাদের দাবি মানতে বাধ্য হবে।

এদিকে ২০২৩ সালের মাঝমাঝি থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ধীরে ধীরে সক্রিয় হওয়া বিএনপির বড় উদ্বেগ ছিল চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে। কারণ দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় সাজা হওয়া সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অসুস্থতা দিনে দিনে জটিল হয়েছে। লম্বা সময় ধরে তাকে হাসপাতালেই থাকতে হচ্ছে। কবে নাগাদ হাসপাতাল ছাড়বেন, ছাড়লেও ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা আপাতদৃষ্টিতে নেই বললেই চলে। তাই দলীয় প্রধানের অসুস্থতা সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের।

আরও পড়ুন

আন্দোলনের কৌশল পাল্টাচ্ছে বিএনপি!
আন্দোলন চালিয়ে যাবে বিএনপি, কর্মসূচিতে ভিন্নতা আনার চিন্তা
এবার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক বিএনপির
সরকারের পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন চলছে

এছাড়া দলের শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর গ্রেফতার, মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হওয়ার ঘটনায় বছরজুড়েই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল বিএনপির শিবিরে, যা এখনো চলছে।

এর বাইরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলে ভাঙন নিয়ে গুঞ্জন থাকলেও বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ছাড়া তেমন আলোচিত কোনো নেতা দল ছাড়েননি। অবশ্য দলে দীর্ঘদিন পদহীন, সাবেক এমপি কেউ কেউ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। যদিও তাতে গুরুত্ব দেয়নি বিএনপি।

তবে সাবেক জোট শরিকদের কেউ কেউ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।

পাঁচমাসে সাজা হয়েছে ১২শ নেতাকর্মীর

বিএনপির পক্ষ থেকে সর্বশেষ (২৮ ডিসেম্বর) দেওয়া দেয়া তথ্য মতে, গত ২৮ ও ২৯ জুলাই হতে এ পর্যন্ত বিএনপির কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে মোট গ্রেফতার হয়েছেন ২৬ হাজার ৭৫১ জন নেতাকর্মী। এই সময়ে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৯৪টির বেশি, মোট আসামি হয়েছে ৯৮ হাজার ২৩১ জন, আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৩৯ জনের বেশি নেতাকর্মী। আর মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের। এর বাইরে কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে একজন সাংবাদিক মারা গেছেন।

BNP_2023-3

এছাড়া ৮১টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও ১ হাজার ২৬৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে দলটি।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) নাশকতার দায়ে রাজধানীর গুলশান থানায় করা মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন ও মেজর হানিফের ২১ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

যদিও বছরজুড়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তব্যে ছিল সরকার পতনের ডাক। তাদের ডাকে বিক্ষোভে, সামাবেশে, মিছিলে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও ছিল উল্লেখযোগ্য। অবশ্য মহাসচিবসহ তাদের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই এখন কারাগারে। কারও কারও হয়েছে সাজা। কেউ আবার শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ।

আন্দোলনের প্রস্তুতি

২০২৩ সাল নির্বাচনি বছর ধরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জানুয়ারি থেকেই সরকারের পতনের আন্দোলনে সরব হয়ে ওঠে বিএনপি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে চলে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর এই প্রক্রিয়া শুরু হতে দেখা যায় ২০২২ সালের অক্টোবরে। ওই সময় সারা দেশে সাংগঠনিক বিভাগগুলোতে ধারাবাহিক সমাবেশ কর্মসূচি করে বিএনপি, যা শেষ হয় ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠের সমাবেশের মধ্যদিয়ে। সেই সমাবেশ থেকে সংসদ বিলুপ্তি, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিসহ ১০ দফা ঘোষণা করে দলটি।

সফলতা আসেনি এক দফার আন্দোলনে

নানা কর্মসূচির মধ্যে এগোতে থাকা বিএনপি বছরের মাঝামাঝিতে আসে এক দফায়। গত ১২ জুলাই রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ থেকে ঘোষণা হয় সরকার পতনের এক দফার ডাক।

এক দফার ঘোষণায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দলসমূহ যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও সফল করার লক্ষ্যে এই এক দফা।’ এই সমাবেশে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন, যা ছিল দলের নেতাকর্মীদের কাছে চমক। সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ দলের কর্মসূচিকে বেগবান করেছে বলে মনে করা হয়।

আরও পড়ুন

অসহযোগ আন্দোলনে কতটা সফল হবে বিএনপি?
যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির অর্জন কী?
বিএনপির আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী!
‘বিএনপির একজন কর্মী বেঁচে থাকা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে’

যুগপৎ আন্দোলনে নতুন মিত্রদের খোঁজ

জুলাইয়ে সরকার পতনের এক দাবির ডাকের পর অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে মাঠে নামে বিএনপি। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির আন্দোলনের গতিপথেও আসে বৈচিত্র্য। পুরানো জোট অনানুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য যুগপৎ আন্দোলনের নামে ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে ওঠে জোট মিত্ররা। এ সময়ে বিএনপির রাজনীতিতে দৃশ্যপটে আসেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

এরই মধ্যে ঘনিয়ে আসে নির্বাচনের সময়। দিন যত যায়, বিএনপির এক দফার দাবি আরও জোরাল হয়। বিপরীতে চলে দল ভাঙার বহু চেষ্টা-ফিকির। নির্বাচন ঘিরে বিএনপির একাধিক নেতা ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে, শেষ পর্যন্ত চলতি বছরে বিএনপিতে চূড়ান্ত কোনো ভাঙন দেখা যায়নি।

চাপে পড়ার ২৮ অক্টোবর!

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করে বিএনপি। ওইদিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের একপর্যায়ে মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। পরদিন ২৯ অক্টোবর ঢাকার সব প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়া হয়। একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় তিনদিনের অবরোধ। ওই মহাসমাবেশের পরপরই দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হন। এরমধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলটির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাও কারাবন্দির জীবন শুরু করেন। এরপর গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান মাঠে সক্রিয় থাকা অনেক নেতাকর্মী।

রাজনীতির মাঠে ফিরেছে বহু আগের অসহযোগ

বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া কর্মসূচি তফসিল ঘোষণার পর গতি পায়। তারা দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিতে শুরু করে। ৩১ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ এবং চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল পালন করে বিএনপি ও সমমনারা। ১৯ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের পরে আপাতত গণসংযোগে মন দিয়েছে বিএনপি।

এরইমধ্যে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করে সর্বসাধারণের প্রতি সরকারকে অসহযোগিতার আহ্বান জানায় বিএনপি। গত ২০ ডিসেম্বর সরকারের পদত্যাগ দাবিতে সারা দেশে এই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় দলটি। তবে এখনো অসহযোগ আন্দোলনের তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি রাজনীতিতে।

BNP_2023-2

বড় আশঙ্কায় ছোট ধাক্কা!

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদধারীসহ অন্তত ২৫ জন নেতা দল ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নেন। সাংগঠনিক ও ভোটের মাঠে এই নেতাদের তেমন গুরুত্ব না থাকলেও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম এবং দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সঙ্গী বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীককে শেষ পর্যন্ত জোট ছেড়ে চলে যাওয়া আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। বহিষ্কৃত নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার তৃণমূল বিএনপিতে গিয়ে আলোচনার জন্ম দেন।

যদিও সরকারি দলের তরফে বিএনপির অনেক নেতা ভোটে যাবেন— এমনটা বারবার বলা হয়েছে।

লম্বা সময় হাসপাতালেই কাটল খালেদা জিয়ার

বছরজুড়েই দলের চেয়ারপাসন অসুস্থ খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ইস্যুটিও ছিল বিএনপির আলোচনার কেন্দ্রে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে কারামুক্ত খালেদা জিয়া বর্তমানে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কখনও কেবিনে আবার কখনও আইসিইউতে রেখে তার চিকিৎসা চলছে। এরই মধ্যে গত ২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় এসে ২৬ অক্টোবর খালেদা জিয়ার অস্ত্রোপচার করেন। বছরের শেষদিকে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতির খবর আসে। তবে, এই মুহূর্তে বাসায় ফিরতে পারছেন না তিনি। থাকতে হচ্ছে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে।

বিইউ