সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গঠন করেছে বিএনপি। ডান-বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে দলটি।
গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করে বিএনপি। এরপর থেকে পদযাত্রা, বিক্ষোভ সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকলেও বিরোধী দলগুলো একই দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে- এটাকে সফলতার প্রথম ধাপ হিসেবে মনে করছে বিএনপি।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে তৃণমূল পর্যন্ত আপাতত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। পাশাপাশি এসব কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষকেও সম্পৃক্ত করার কথা ভাবছে। এরই অংশ হিসেবে পদযাত্রা, বিক্ষোভ আর লংমার্চের মতো কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে চায় দলটি। চূড়ান্ত আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত এভাবেই কর্মসূচি চালিয়ে যাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি।
>> আরও পড়ুন: সরকারের পতন ঘটানো পর্যন্ত আন্দোলন চলবে: ১২ দলীয় জোট
যদিও বিএনপিকে একাধিকবার তৃণমূলের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে কার্যকর আন্দোলন নিয়ে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে বারবার এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর রাজপথ উত্তপ্ত করতে ব্যর্থ ঢাকা মহানগর বিএনপি।
যুগপৎ আন্দোলনের অর্জন সম্পর্কে বিএনপি নেতারা বলেন, যুগপৎ আন্দোলনকে শক্তি হিসেবে দেখছে বিএনপি। বিন্দু বিন্দু জল দিয়ে যেমন সাগর হয়, বিএনপির সাথে যারা যোগ হচ্ছে, আন্দোলনে করছে, এতে শক্তি বাড়ছে। কারণ সরকারের সাথে জনগণ নেই, তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায় করতে চায় সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকা মেইলকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। কিন্তু গত এক বছর ধরে বিএনপি নানান দাবিতে এককভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সেই দাবিগুলো অধিকাংশই জনকল্যাণমুখী।
তিনি বলেন, মিত্র দলগুলো বাইরে থেকে যুগপৎ আন্দোলনে আমাদের ১০ দফায় সমর্থন জানিয়ে কর্মসূচি পালন করছে, যা সাড়া জাগিয়েছে বলে আমার মনে হয়। কারণ যখন শত্রু আমাদের সমালোচনা করে তখন বুঝতে হবে আমরা ঠিক আছি। শত্রু যখন প্রশংসা করে তখন বুঝতে হবে আমরা বেঠিক আছি। শত্রু বলতে সরকারি বা জোট, তারা তাদের বক্তব্যে যে অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ করেছে তাতে মনে হয় আমরা ঠিকই আছি। কারণ তারা মনে করেছিল বিএনপি শেষ হয়ে গেছে। তারা দেখছে মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। এসব কারণে আমার ধারণা, এভাবে যদি সামনের দিনগুলোতে এগোতে থাকি, সরকারকে এক সময় এই দাবি মানতেই হবে।
>> আরও পড়ুন: আন্দোলনের ‘গতি ধরে রাখতে’ নতুন কী কর্মসূচি দিচ্ছে বিএনপি?
যুগপৎ আন্দোলনে অর্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে ১২ দলীয় জোটের নেতা ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা ঢাকা মেইলকে বলেন, এই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে এতগুলো দল অভিন্ন লক্ষ্যে কর্মসূচি পালন করছি। যার যার অবস্থান থেকে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি, আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ করাই হচ্ছে আপাতত মূল লক্ষ্য। আমরা একটি গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখছি। জনগণ আমাদের সাথে থাকবে। যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি আমরা পালন করেছি, যার যার অবস্থান থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করেছি। এছাড়া আমরা যে মেসেজগুলো জনগণের নিকট দিতে চাচ্ছি, মনে হয় সেটা আমরা পৌঁছাতে পেরেছি।
এদিকে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর নেতারা বলেন, বিভিন্ন দল একসাথে কাজ করতে গেলে অনেক ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। সব সমস্যা কাটিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্মসূচি চালানো হচ্ছে। সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিএনপির সাথে কোনো ঘাটতি নেই। সমন্বয়ের মাধ্যমেই কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয় ও ঘোষণা করা হয়। যুগপৎ আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া মিলছে। দিন দিন এই কর্মসূচিতে জনবল বৃদ্ধি পাচ্ছে।
>> আরও পড়ুন: জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যে কৌশলে মাঠে থাকবে বিএনপি
সমমনা দলগুলো যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপিকে কি পরিমাণে সহযোগিতা করছে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা মেইলকে বলেন, এ ধরনের আন্দোলনে জাতিকে একীভূত করার জন্য সবাইকে একত্রিত করা প্রয়োজন। তারা যে একত্রিত হয়েছে- এটাই আমাদের সহযোগিতা। তাদের যতটুকু ক্ষমতা রয়েছে তারা সেই ক্ষমতা নিয়ে মাঠে রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, জনগণ অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করছে। সেই অধিকারের জন্য আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দাবি হচ্ছে জনগণের নিরাপত্তা, জনগণের অধিকার, ভোটের অধিকার, গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার। এটার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জনগণ আমাদের সাথে রয়েছে। বর্তমান সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ঢাকা মেইলকে বলেন, তারা তাদের সব রকমের আন্তরিকতা দিয়ে সহযোগিতা করছে। কর্মসূচিগুলো মূলত আমরা দিচ্ছি, তাদেরকে জানাচ্ছি একদম শেষ দিকে আমাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পরে। তাদের প্রস্তুতি থাকে সেই অনুযায়ী কর্মসূচি ঘোষণা করার এটা প্রমাণিত। তিনি বলেন, এমন হয়েছে যে তাদের একটি কর্মসূচি চলতেছে, সামনে কি কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে এটা আমাদের কাছ থেকে জেনে তারপর ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচি চলাকালীন তারা জেনে নেয়।
সমমনা দলগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে কিনা জানতে চাইলে আলাল বলেন, কথা তারা রাখতে পারছে, তাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের কারণে কোনো সময় হয়তো কিছু হয়, এটার মাত্রা খুবই কম। তারা নিজেরা আবার ওটা ঠিক করে নেয়।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, যেকোনো কর্মসূচি ঘোষণার পূর্বে বিএনপি আমাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করার মাধ্যমেই কর্মসূচি নির্ধারণ করে। সেই অনুযায়ী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
>> আরও পড়ুন: বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ‘মনোমালিন্য’
জানতে চাইলে ১২ দলীয় জোটের নেতা ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের একটাই চাওয়া- সেটা হচ্ছে বর্তমান দুঃশাসনের হাত থেকে দেশকে এবং দেশের জনগণকে বাঁচানো। যেভাবে প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অর্থপাচার এবং ঋণের জালে মানুষকে ফাঁসানো হচ্ছে, এর থেকে মুক্ত পাওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপির কাছে সাপোর্ট চাওয়ার কিছু নাই। বিএনপি যুগপৎ আন্দোলন করছে, আমাদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে, এভাবেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিএনপির সাথে কোনো ঘাটতি নেই। আমাদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমেই কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয় এবং কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
যুগপৎ আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি থেকে যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা সেটা পাচ্ছেন কিনা এবং সমন্বয় ঠিক হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মসূচি পালন করছি, বিএনপি তাদের কর্মসূচি পালন করছে। আমরা তো বিএনপির উপর নির্ভরশীল নই।
জুনায়েদ সাকি বলেন, আমাদের লিয়াজোঁ কমিটির মাধ্যমে কর্মসূচি নির্ধারিত হয়। সেই অনুযায়ী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী লড়ছে। বিএনপি বিএনপির প্রোগ্রাম করছে, আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মসূচি পালন করছি। যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছে সেগুলো আমাদের লিয়াজোঁ কমিটির মাধ্যমে ঠিক করা হচ্ছে।
এমই/জেএম