আব্দুল হাকিম
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩০ এএম
* ঢাকায় ২ কোটিরও বেশি মানুষের চাপ
* অতিরিক্ত নগরায়নে যানজট ও দূষণ তীব্র
* রাজশাহী-খুলনাসহ আঞ্চলিক শহর উন্নয়নের সুপারিশ
* প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তাব
* দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের দাবি
ঢাকা যেন পুরো বাংলাদেশের ভার বইছে। জনসংখ্যা, যানবাহন, শিল্প প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন সবকিছু যেন এই এক শহরেই গাদাগাদি। ফলে যানজট, দূষণ ও আবাসন সংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। অথচ দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক শহর সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পিছিয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন দেশের টেকসই উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। এজন্য আঞ্চলিক শহরগুলোর সম্ভাবনার দিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা।
আরও পড়ুন: বেপরোয়া হিজড়া, আতঙ্কিত নগরবাসী
১৯৬০ সালে নগর জনসংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ ছিল, বর্তমানে তা প্রায় ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। ঢাকায় বাস করছে ২ কোটিরও বেশি মানুষ। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটসহ অন্যান্য শহরেও জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এর ফলে যানজট, দূষণ, আবাসন সংকট ও স্বাস্থ্যসেবার চাপ বাড়ছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)-এর ২০২৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকা জেলা দেশের মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ২১ শতাংশ পাচ্ছে। বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল পাচ্ছে ৩২ শতাংশ, চট্টগ্রাম অঞ্চল ১৫ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে। কিন্তু বৃহত্তর কুষ্টিয়া (১.৫৩%), পার্বত্য অঞ্চল (১.৬০%), বৃহত্তর বগুড়া (১.৬৮%) ও বৃহত্তর দিনাজপুর (১.৮০%) সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নগরায়ন কেবল ঢাকা বা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক থাকলে তা দেশের টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত করবে। সুষম নগরায়নের জন্য বহুকেন্দ্রিক উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা ছাড়া রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও সিলেটকে আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধির কেন্দ্র হিসেবে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্প এলাকা ও প্রশাসনিক সুবিধা রাজধানীতে সীমাবদ্ধ না রেখে আঞ্চলিক শহরগুলোতে ছড়িয়ে দিতে হবে।
তারা বলছেন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণও জরুরি। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের শাখা আঞ্চলিক পর্যায়ে গঠন করা গেলে স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে, সেবা দ্রুত পৌঁছাবে এবং ঢাকামুখী অভিবাসনও কমবে। একইভাবে আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দেওয়া হয়। স্থানীয় পর্যায়ে কর আদায়, সরকারি অনুদানের সুষম বণ্টন এবং উন্নয়ন বাজেটে ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অবকাঠামো ও সেবার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন দেশের জন্য গুরুতর হুমকি। বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া এ সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনগত সংস্কার, প্রশাসনিক ক্ষমতা বণ্টন ও আর্থিক স্বাবলম্বিতা ছাড়া এ প্রক্রিয়া কার্যকর হবে না। এখনই সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন না করলে ভবিষ্যতে নগর সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ প্লানার্স ইনস্টিটিউটে এক প্রেজেন্টেশনে বলা হয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ও তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো সমানভাবে আঞ্চলিক শহরে ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল রাজধানীতে না থেকে বিভাগীয় শহরগুলোতেও স্থাপন করা উচিত। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) ইন্ডিভিজ্যুয়াল কনসালটেন্ট এবং ফেলো মেম্বার পরিকল্পনাবিদ আনিসুর রহমান তুহিন।
পরিকল্পনাবিদ আনিসুর রহমান বলেন, শিল্প ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রসার ঘটানো ছাড়া বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয়। এজন্য প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে এবং গ্রামীণ শিল্প ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে প্রণোদনা দিতে হবে। এতে স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং মানুষ ঢাকামুখী হতে নিরুৎসাহিত হবে। এছাড়া টেকসই নগরায়নের জন্য সবুজ এলাকা, জলাধার ও কৃষিজমি সংরক্ষণ অপরিহার্য। উপকূল ও নদীবিধৌত এলাকায় টেকসই পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে নগরায়নের প্রক্রিয়া আরও ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা জানিয়ে আনিসুর রহমান বলেন, জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০ থেকে ৩০ বছরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে হবে। দ্রুতগামী রেল ও এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে আঞ্চলিক শহরের সরাসরি সংযোগ স্থাপন জরুরি। ‘এক ঘণ্টার শহরনীতি’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিভাগীয় শহরের সঙ্গে আশপাশের এলাকার উন্নত যোগাযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব।
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে ওয়াসার পানি
স্মার্ট সিটি ও ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে পরিকল্পনাবিদ আনিসুর রহমান বলেন, গ্রামীণ পর্যায়ে কমিউনিটি হাসপাতাল ও ডিজিটাল সেন্টার উন্নত করা গেলে নগর নির্ভরতা কমবে। পাশাপাশি আঞ্চলিক শহরগুলোকে স্মার্ট সিটি হিসেবে উন্নীত করলে তরুণ প্রজন্ম স্থানীয় পর্যায়ে কাজের সুযোগ পাবে। অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ব্যবস্থাপনা ও শহর–গ্রাম সংযোগ শক্তিশালী করার দিকেও নজর দিতে হবে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ অঞ্চলভেদে সৃষ্টি করতে পারলে জনসংখ্যার সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে। গ্রামীণ এলাকায় আধুনিক কৃষি, বাজার ও সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নত হলে স্থানীয় উন্নয়ন শহরের সঙ্গে সমন্বিত হবে। নগর উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন করতে হবে, যাতে নগরচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেছেন, দেশের উন্নয়ন বাজেটের বড় অংশ ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এভাবে দেশের জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বাজেট বরাদ্দে স্পষ্ট বৈষম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আদিল মুহাম্মদ বলেন, দেশের এডিপি প্রকল্পে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত সাতটি জেলা মোট বরাদ্দের অর্ধেক পাচ্ছে, অথচ ২৫টি স্বল্প বরাদ্দপ্রাপ্ত জেলা পাচ্ছে মাত্র ১৩ ভাগ। ঢাকাকেন্দ্রিক প্রকল্প যেমন মেট্রোরেল, পাতাল রেল ও এক্সপ্রেসওয়ে দেশের অন্যান্য শহরের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে না। এছাড়া শতাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হলেও বেশিরভাগ ঢাকা ও এর আশপাশে অবস্থান করছে। বিশ্বের উন্নতশীল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চীনের সাংহাই, গুয়াংজো, চংকিং বা ভারতের মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতা, ব্যাঙ্গালোর দেখাচ্ছে, বিকেন্দ্রীকরণ উন্নয়নকে টেকসই করে। জার্মানি এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও রাজধানী শহরের পাশাপাশি অন্যান্য শহরে সমানভাবে উন্নয়ন ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঢাকার বাইরে দেশের সমস্ত বিভাগীয় শহর ও আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোতে সমান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: বৃষ্টি নয়, দুর্নীতিতেই ডুবছে রাস্তা!
আদিল মুহাম্মদ বলেন, ‘মানুষের দেশের যেকোনো অঞ্চলে কাজের সুযোগ থাকলে তারা ঢাকার দিকে চাপ দেবে না। বর্তমানে গ্রামের স্কুলে মানসম্মত শিক্ষক নেই, ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভালো চিকিৎসা সেবা নেই। এই পরিস্থিতিতে মানুষ ঢাকায় অভিমুখী হচ্ছে। উত্তরা ইপিজেডের উদাহরণ দেখাচ্ছে, স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি ও আনুষঙ্গিক সেবা খাতের বিকাশের মাধ্যমে আঞ্চলিক উন্নয়ন সম্ভব। ঢাকাকেন্দ্রিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া বৈষম্যহীন ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। ঢাকাই বাংলাদেশ নয়, দেশের প্রতিটি অঞ্চলের জন্য পরিকল্পিত উন্নয়ন এখনই জরুরি।’
এএইচ/এমআর