রাজধানী ঢাকার নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি বিশুদ্ধ পানির সংকট। প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ কোটি লিটার পানি উৎপাদন ও সরবরাহ করে ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ পানির মান কেমন, তা নিয়ে বছরের পর বছর প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
সম্প্রতি নগরবাসীর অভিযোগ আরও বেড়েছে। ওয়াসার পানিতে পোকা, দুর্গন্ধ, অস্বচ্ছতা ও নানা রোগজীবাণুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসব অভিযোগ যাচাই করতে গিয়ে বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষায়ও উদ্বেগজনক ফলাফল পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ওয়াসার পানি এখন নগরবাসীর জন্য এক বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি।
বিজ্ঞাপন
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন কল খুললেই বাসিন্দারা অস্বচ্ছ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি পাচ্ছেন। কোথাও কোথাও পানির ভেতর থেকে পোকা বের হচ্ছে, আবার কোথাও মিশ্রিত হচ্ছে কাদার মতো কালো পদার্থ। সরাসরি খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি রান্নার কাজেও এই পানি ব্যবহার করা যায় না। ফলে মানুষ বাধ্য হচ্ছেন পানি ফুটিয়ে খেতে অথবা ফিল্টার ব্যবহার করতে। কিন্তু সবসময় ফুটানো বা ফিল্টারের মাধ্যমে ক্ষতিকর জীবাণু পুরোপুরি নির্মূল হয় না। এতে বারবার ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েডসহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী।
বিশ্লেষকরা এ অবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন ওয়াসার পুরোনো ও ভাঙাচোরা পাইপলাইন। রাজধানীর বহু এলাকায় এখনো পুরোনো লিকেজযুক্ত পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়। এসব পাইপলাইনে চারপাশের নোংরা পানি ঢুকে যায় এবং তা কলের পানির সঙ্গে মিশে মানুষের ঘরে পৌঁছায়। ফলে বাসিন্দারা একদিকে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন নিয়মিত। এছাড়া বাসাবাড়ির বা ফ্ল্যাটের রিজার্ভারও গুরুত্বপূর্ণ। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাংক, ছাদের ওপরের ওভারহেড ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না হলে পানি দূষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাক বা অন্যান্য পাখি পানি খাওয়ার সময় মারা গেলে অথবা তাদের মল পড়লে পানি আরও দূষিত হয়।
সোবহানবাগের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকায় ওয়াসার পানিতে পোকা-মাকড় তেমন দেখা যায়নি, তবে শুনেছি কিছু জায়গায় পোকা দেখা গেছে। তবে মাঝে মাঝে কল খুললেই হলুদাভ পানি আসে আর সঙ্গে দুর্গন্ধ। তবে সবসময় হয় এটা বলা যাবে না, মাঝে মাঝে এমন হয়। এই পানি দিয়ে গোসল বা কাপড় ধোয়ার পরও গায়ে চুলকানি ওঠে। শিশুরা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কল্যাণপুরের গৃহবধূ সুমি আক্তার বলেন, আমাদের বাসার ট্যাংক প্রতি বছর পরিষ্কার করা হয়, তারপরও যে পানি আসছে তা পানের অযোগ্য। দুর্গন্ধে রান্নায় ব্যবহার করা যায় না, আর পান করলে পেটের সমস্যা হয়। শিশুরা বারবার ডায়রিয়া আর জ্বরে ভুগছে। ওয়াসার কর্মকর্তারা দোষ চাপান আমাদের ওপর—বলেন ট্যাংক পরিষ্কার না করলে নাকি সমস্যা হয়।
মগবাজারের মুদি দোকানি কামাল হোসেন বলেন, কল খুললেই দুর্গন্ধযুক্ত পানি আসে। বাধ্য হয়ে পানির জার কিনতে হচ্ছে, অথচ প্রতি মাসে বিল ঠিকই দিতে হয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির ভৌত-রাসায়নিক ও জীবাণুগত মান অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ মানদণ্ডের বাইরে। মিরপুর এলাকার দুটি অঞ্চলের পানির পরীক্ষা করে গবেষকরা দেখেছেন, বেশির ভাগ পানিতেই কলিফর্ম ও ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। এই ব্যাকটেরিয়া সরাসরি পানিবাহিত নানা রোগের জন্য দায়ী। গবেষকরা সতর্ক করেছেন, এই পানি ফুটানো ছাড়া সরাসরি খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে। এর আগেও বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, ওয়াসার পানিতে শুধু জীবাণুই নয়, ক্ষতিকর রাসায়নিকও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে দূষিত পানি পান করলে শুধু পেটের অসুখই নয়, বরং কিডনি, লিভার এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। শিশু ও বয়স্করা এসব ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি ভোগেন। গরিব ও বস্তি এলাকায় যাদের বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
ঢাকার অনেক পরিবার এখন প্রতি মাসে অতিরিক্ত কয়েক শ টাকা ব্যয় করছেন শুধু পানি ফুটানোর জন্য গ্যাস বিল দিতে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে বোতলজাত পানি কিনে খাচ্ছেন, ফলে তাদের আর্থিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে। আর যাদের আয় সীমিত, তারা সরাসরি ওয়াসার পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে তারা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, কিন্তু চিকিৎসার খরচ বহন করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীর বস্তি ও নিম্ন আয়ের এলাকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেখানে অনেক পরিবার একসঙ্গে একটি সংযোগ থেকে পানি সংগ্রহ করেন। পানির মান খারাপ হলে সবাই একযোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির এই সমস্যা সমাধানে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নিয়মিত পানির মান পরীক্ষা করে তার ফলাফল জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। লিকেজযুক্ত পুরোনো পাইপলাইন দ্রুত পরিবর্তন করতে হবে। পরিশোধন প্ল্যান্ট আধুনিকায়নের মাধ্যমে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও জীবাণু নির্মূল করতে হবে। ওয়াসার কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে যাতে নাগরিকরা আর ভোগান্তিতে না পড়েন। একই সঙ্গে নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে পানি ফুটিয়ে বা ফিল্টার ব্যবহার করে পান করতে হবে, অন্তত প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য।
জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ আব্দুস সবুর ঢাকা মেইলকে বলেন, ঢাকার ওয়াসার পানি উৎসের দিক থেকে নিরাপদ হলেও গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর সময় বিভিন্ন কারণে দূষিত হয়ে যাচ্ছে। ওয়াসা পানি মাটির নিচের পাইপ, নদী বা জলাধার থেকে পরিশোধিত করে পাঠায়, তাই তাত্ত্বিকভাবে এটি নিরাপদ। কিন্তু পাইপলাইন, রক্ষণাবেক্ষণ ও বাসাবাড়ির জলাধরের অবস্থা অনুযায়ী পানি দূষিত হতে পারে।
তিনি জানান, ঢাকার পানির পাইপের পাশে স্যুয়ারেজ পাইপ থাকে, যা অনেক পুরোনো। শুরুতে আয়রন বা স্টিলের পাইপ ব্যবহার করা হলেও সময়ের সঙ্গে ক্ষয়, জং এবং ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটল বা ফুটোর কারণে ময়লা পানি ওয়াসার পানির সঙ্গে মিশে দূষণ সৃষ্টি করে। এছাড়া পাইপে অবৈধ সংযোগও পানির মান খারাপ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
ডা. সবুর আরও বলেন, বাসা বা ফ্ল্যাটের রিজার্ভারও গুরুত্বপূর্ণ। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাংক, ছাদের ওপরের ওভারহেড ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না হলে পানি দূষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাক বা অন্যান্য পাখি যদি পানি খাওয়ার সময় মারা যায় অথবা তাদের মল পড়ে, তবে পানি আরও দূষিত হয়। ২০ বছরের পুরোনো পাইপ এবং জং ধরা পাইপেও পানির রাসায়নিক ও দূষণ বৃদ্ধি পায়।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, পানি ফুটিয়ে খাওয়া সবসময় পুরোপুরি নিরাপদ নয়। ঢাকার কিছু এলাকায় আয়রন ও অন্যান্য উপাদানের কারণে পানি হলুদ বা দূষিত হতে পারে, যা শুধু ফুটিয়ে পরিষ্কার করা যায় না। এছাড়া নাগরিকদের নিজস্ব ট্যাংক, পাইপ এবং জলাধর রক্ষণাবেক্ষণ না করলে দূষণ আরও বাড়ে। এই সমস্যা সমাধানে উভয় পক্ষের দায়িত্ব আছে। ওয়াসার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পাইপলাইনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা দরকার। একই সঙ্গে নাগরিকদেরও তাদের ট্যাংক ও পাইপ নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। অন্যথায় দূষিত পানি ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, চর্মরোগসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য আরও বিপজ্জনক হবে।
ওয়াসার লাইনে কোনো সমস্যা নেই বলে দাবি করেছেন ঢাকা ওয়াসার (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম সহিদ উদ্দিন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের প্রধান নেটওয়ার্ক পুরোপুরি বদলে ফেলে নতুনভাবে বসানো হয়েছে। এখানে কোনো লিকেজ নেই, ময়লা ঢোকার সুযোগও নেই। নতুন প্রধান নেটওয়ার্ক কানেক্টেড পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হয় এবং সেই পানি সরাসরি নতুন নেটওয়ার্কে সরবরাহ করা হয়। ফলে বাইরের কোনো উপাদান ঢোকার সুযোগ নেই। তারপরও আমরা নিয়মিত ক্লোরিনেশন করি, যা একটি মানসম্মত প্রক্রিয়ার অংশ। যদি কোনোদিন ক্ষুদ্র জীবাণু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রবেশ করেও থাকে, ক্লোরিনেশন সেটিকে নির্মূল করে। এজন্যই পরীক্ষামূলকভাবে ক্লোরিন মিশ্রণ দেওয়া হয়। সুতরাং ওয়াসার লাইনে দূষণের কোনো কারণ নেই।’
ওয়াসা কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক সময় মানুষ আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়ে পানি খেতে চায় না, কারণ তাদের ধারণা, ওয়াটার রিজার্ভারে গাড়ির ট্রায়াল বা অন্য কারণে দূষণ হতে পারে। এটি মূলত মানসিকতার বিষয়। তবে কার্যত এ ধরনের দূষণের আশঙ্কা থাকলেও আমাদের নেটওয়ার্কে সেই সুযোগ নেই।’
এএইচ/জেবি

