শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বৃষ্টি নয়, দুর্নীতিতেই ডুবছে রাস্তা!

আব্দুল হাকিম
প্রকাশিত: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

বৃষ্টি নয়, দুর্নীতিতেই ডুবছে রাস্তা!

রাজধানী ঢাকায় অল্প বৃষ্টিতেই রাস্তায় হাঁটুপানি জমে খানাখন্দ আর যানজটে নাকাল নগরবাসী। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে গলিপথ—সবখানেই একই দৃশ্য। কিন্তু এর পেছনে একমাত্র দায়ী কি বৃষ্টি কিংবা বর্ষা? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ দুর্নীতি, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার এবং তদারকির অভাব।

গত সপ্তাহে রাজধানীতে মাত্র কয়েক মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, যা মৌসুমি স্বাভাবিক বৃষ্টির তুলনায় অনেক কম। মাত্র এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মালিবাগ, রামপুরা, মতিঝিল, পুরান ঢাকা, উত্তরা, বনানীসহ বহু এলাকার সড়কে হাঁটুপানি জমে যায়। কোথাও কোথাও রাস্তায় বড় বড় গর্ত হয়ে যায়, যা গাড়িচালকদের জন্য মরণফাঁদে পরিণত হয়।


বিজ্ঞাপন


Construction_corruption_(2)

রাজধানীর বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিদিন রাস্তার গর্ত, হাঁটুপানি ও যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হয়। অফিসগামী মানুষ দেরি করে পৌঁছান, স্কুলপড়ুয়া শিশুদের পড়াশোনায় প্রভাব পড়ে। জরুরি সেবা, যেমন অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, রাস্তার খারাপ অবস্থার কারণে সময়মতো পৌঁছাতে পারছে না। মিরপুর ১০ এর ব্যবসায়ী কামরুল হাসান বলেন, তার দোকানে মাল আনতে ট্রাক ঢুকতে পারে না। রাস্তায় গর্ত ও পানি জমে থাকে, মাল নামাতে কষ্ট হয়।  

আরও পড়ুন:

গাজীপুরে ইটাহাটা কলাবাগান আঞ্চলিক সড়কের বেহাল দশা, দুর্ভোগ চরমে

রিকশাচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি হলে পানি এত দ্রুত জমে যায় যে, কোন গর্ত কোথায় বোঝা যায় না। একবার রিকশার চাকা গর্তে পড়ে উল্টে গিয়েছিল, যাত্রী আহত হয়েছিল।


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত রাজধানীতে রাস্তার গর্ত বা খারাপ অবস্থার কারণে ছোট-বড় প্রায় ৪৫০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অন্তত ২৭ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে প্রতিদিন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। বাসচালক জাকির হোসেন জানান, গাড়ি চালাতে ভয় লাগে। গর্তে হঠাৎ চাকা পড়লে গাড়ি ভারসাম্য হারায়, যাত্রী ঝুঁকিতে পড়ে।

দুই সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীদের কথা বলে জানা গেছে, রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারে নির্ধারিত মানের সিমেন্ট, বালু, পাথর ও বিটুমিন ব্যবহার করা হয় না। টেন্ডার জেতা ঠিকাদাররা লাভ বাড়ানোর জন্য কম পরিমাণে এবং নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করেন। ফলে কাজ শেষ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই রাস্তার ওপর ফাটল ধরে, বিটুমিন উঠে যায়। 

এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, যে সড়ক পাঁচ থেকে সাত বছর টেকার কথা, সেটি ছয় মাসেই খারাপ হয়ে যায়। এর মূল কারণ দুর্নীতি। ঠিকাদার, তদারকি কর্মকর্তা এবং কিছু প্রভাবশালী মিলে গুণগত মানের সঙ্গে আপস করেন। 

আরও পড়ুন:

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য ৩ হাজার ৮৪১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে বাজেটের প্রধান খাতগুলোর মধ্যে সড়ক ও ট্রাফিক অবকাঠামো খাতে ৩৬৫ কোটি ১১ লাখ, খাল উন্নয়ন ও জলাবদ্ধতা নিরসন খাতে ১১৫ কোটি, নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতে ৫৭ কোটি ২০ লাখ, মশক নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য খাতে ৫৭ কোটি ৪৪ লাখ, বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ উন্নয়ন খাতে ৫ কোটি ২৬ লাখ এবং কল্যাণমূলক খাতে ১৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৬ হাজার ৬৯ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় ৭৬ শতাংশ, অর্থাৎ ৪ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়নে। এ খাতে ২ হাজার ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৩৩ শতাংশ।

 

কিন্তু মাঠপর্যায়ে সেই কাজের মান অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাজেট অপচয় বা দুর্নীতিতে হারিয়ে যায়। রাস্তা নষ্ট হওয়ার আরেকটি বড় কারণ অকার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা। বৃষ্টি হলেই পানি জমে থাকে, কারণ ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরা থাকে। পানি বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রাস্তার পানি দীর্ঘ সময় ধরে নামতে পারে না।

বনানীর বাসিন্দা সাদিয়া রহমান জানান, তাদের এলাকায় মাত্র এক বছর আগে রাস্তা নতুন করে বানানো হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। ড্রেন সাফ করা হয় না, তাই রাস্তা নষ্ট হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত ৫ বছরে রাস্তার বেহাল অবস্থা এবং দুর্ঘটনার কারণে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২৮ হাজার ২৯৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯ হাজার ৫২২ জন নিহত এবং ৫৮ হাজার ৭৯১ জন আহত হয়েছেন। 

Construction_corruption_(3)

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের মানুষ আজ বৃষ্টির জন্য নয়, দুর্নীতির জন্য ডুবে আছে। সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা শুধু অবকাঠামোগত ব্যর্থতার চিত্রই তুলে ধরে না, এটি প্রশাসনিক উদাসীনতা ও দুর্নীতির নগ্ন বাস্তবতাও প্রকাশ করে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে কয়েক বছরের মধ্যেই রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থা আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, আর এর খেসারত দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা মেইরকে বলেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের একটি কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি। আমরা পৃথিবীর উন্নত দেশের পরামর্শ অনুসারে সড়ক মেরামত করলেও এখন দেখতে পাচ্ছি, বৃষ্টি হলেই সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উচ্চ ব্যয়ে সড়ক নির্মাণের পর যদি তা দ্রুত ভেঙে যায়, তাহলে তা সড়কের নষ্ট হওয়া ছাড়াও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

মোজাম্মেল হক বলেন, সড়ক উপদেষ্টা নিজেও বলেছেন, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে সড়ক নির্মাণ ব্যয় অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে নতুনভাবে নির্মিত সড়কও টিকছে না। আমার মতে, এ বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সড়ক নির্মাণ বা মেরামতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের টেকসই অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে হবে, যাতে সড়কের স্থায়িত্ব ও মান নিশ্চিত হয়।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ রাস্তা 'বিটুমিন' দিয়ে নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বিটুমিনের একটি বড় সমস্যা হলো—এটি পানির সংস্পর্শে এলে এর বাইন্ডিং ক্ষমতা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। শীতকালে এই প্রভাব তেমন বোঝা যায় না, কিন্তু বর্ষাকালে বা জলাবদ্ধ এলাকায় বিটুমিনের রাস্তা সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যখন বিটুমিনের রাস্তার ওপর পানি জমে এবং তার ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করে, তখন বন্ডিং দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়ে। বিশেষ করে রাস্তার নিচেও পানি জমে থাকলে গাড়ির চাপের কারণে দ্রুত গর্ত ও ভাঙন দেখা দেয়। এই সমস্যাকে আমরা শুধু ‘রাস্তা খারাপভাবে নির্মিত’ বলেই ব্যাখ্যা করতে পারি না—এটি বিটুমিনের প্রকৃতিগত সীমাবদ্ধতা।

এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, সমাধানের জন্য আমাদের উচিত, যেসব রাস্তা নিয়মিত জলাবদ্ধ থাকে বা দীর্ঘ সময় পানির সংস্পর্শে আসে, সেখানে বিটুমিনের বদলে কংক্রিট বা সিমেন্টের রাস্তা নির্মাণ করা। ইতোমধ্যে কিছু এলাকায়, বিশেষ করে হাইওয়ের বাজার বা ঘাট সংলগ্ন স্থানে, যেখানে পানি ব্যবহারের হার বেশি, সেখানে সিমেন্টের ব্লক রাস্তা নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জলাবদ্ধতা-প্রবণ এলাকায় কংক্রিটের রাস্তা করাই টেকসই সমাধান।
সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেন, প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে ব্যয় অনেক বেশি দেখা গেছে বিগত আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরে। রাস্তাঘাট দুর্নীতির একটা বড় ক্ষেত্র। এই দুর্নীতি কমালে এবং দেশের প্রকৌশলীরা যদি দেখেন, তাহলে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের ব্যয় কমানো সম্ভব। সড়কের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। অন্যান্য যেসব যাতায়াতের মাধ্যম আছে—রেলপথ, নদীপথ এবং বিমান—এসবের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

উপদেষ্টা বলেন, ঢাকা শহরে এ ধরনের বাইপাস করতে হবে, যাতে বড় শহরকে যানজট থেকে মুক্ত করতে পারি। সড়ক নির্মাণের ব্যয় কমাতে হবে এবং প্রযুক্তিও পরিবর্তন করতে হবে, যাতে বছর বছর রাস্তা খারাপ না হয়ে যায়। এখানে চীনের ঠিকাদার কাজ করছে।

এএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর