মোস্তফা ইমরুল কায়েস
০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৩২ এএম
বিশ্বের সুন্দরতম সমুদ্র সৈকতগুলোর একটি থাইল্যান্ডের পাতায়া বিচ। এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে ছুটে আসেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে যা যা প্রয়োজন তার সবটাই আছে এই সৈকতে। এরমধ্যে প্যারাসেলিং, বোটে ঘোরার সুবিধা, সৈকতে যাত্রীযাপন, জেটস্কি ও বোট রাইডিং অন্যতম। হাতের নাগালে সব সুবিধা থাকায় অনেকে এটিকে প্রশান্তির বিচও বলে থাকেন।
সৈকতের তীরে গড়ে উঠেছে খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট, ম্যাস্যাজ পার্লার ও আনন্দ বিনোদনের বহু মাত্রিক ড্যান্ড ও নাইট শো-ক্লাব। সবকিছুর মধ্যেও অন্যরকম এক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে সৈকতের তীর ঘেঁষা নারিকেল গাছের সারি।
নাজমুল হোসেন একজন বাংলাদেশি নাগরিক। দীর্ঘদিন ধরে থাকেন থায়ল্যান্ডে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী এই প্রবাসী বলেন, এক দিনেই পর্যটনের নগরী হিসেবে গড়ে ওড়েনি পাতায়া। রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও। এখানে সৈকতে সব ব্যবসাই চলে। তবে পর্যটকদের আনন্দ বিনোদন দেওয়া ব্যবসাই বেশি।
নাজমুলের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে ছিলেন রুহুল। তিনি বলেন, রাতের বেলা সৈকত শান্ত। দিন হলে শুরু হয় বোট রাইডিং ও জেটেস্কির প্রতিযোগিতা। এক একটি বোট ও জেটেস্কিতে চড়তে লাইন লেগে যায়। ব্যবসায়ীরা সবাই অনুমোদিত। এছাড়া আছে প্যারাসেলিং। একজন প্যারাসেলিং করতে খরচ নেয় ১ হাজার থেকে ১৬০০ বাত। যা বাংলাদেশি টাকায় ৩ থেকে প্রায় ৫ হাজার টাকা। তবে খারাপ না। পর্যটকরা আনন্দ পান। আর রাতে নারী পুরুষ উভয়ে গল্প গুজব, আড্ডা, আনন্দ ফূর্তি করে রাত কাটায়। ছিনতাই বা ছিঁচকে চোরের ভয় নেই এখানে।
আরও পড়ুন: হর্ন বাজানোকে অপরাধ মনে করেন চালক!
তিনি আরও বলেন, এই বিচে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে সারাক্ষণ দেশটির ট্যুরিস্ট পুলিশ থাকে। তাদের খবর দিয়ে ডেকে আনতে হয় না, তারাই নজরদারী করে কে সৈকতে কী করছে। অসংগতিপূর্ণ কিছু চোখে পড়লেই খবর করে দেয় এই পুলিশ। ফলে এখানে তেমন কিছু ঘটে না বললেই চলে।
রুহুলের কথার প্রমাণ পাওয়া গেছে পাতায়া সৈকতে। সেখানে যাওয়ার পর দিন আমাদের গন্তব্য ছিল কোরাল আইল্যান্ড। সকালে রওনা হয়ে পাতায়া পোর্টে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে চোখ ছানাবড়া। পাহাড়ের কোলে সাগর। তীর ঘেঁষে জেটি। তার ওপর পাহাড়ে বড় করে ইংরেজিতে লেখা পাতায়া সিটি। যা অন্যরকম আবহ তোলে পর্যটকদের মনে। যেকোনো পর্যটক সেই পাতায়া সিটি লেখার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফিতে নিজেকে আবদ্ধ করে লেখাটিসহ।
জানতে পারলাম, সাগর ও কোরাল অ্যাইল্যান্ডে আসা যাওয়া সহজ করতে নতুন নতুন জেটি তৈরি করেছে থাইল্যান্ড সরকার। এতে দেশটির উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ব্যবসার উদ্যোগ নেন।
যাইহোক আসি মূল কথায়। পোর্ট থেকে আমরা জেটি মাড়িয়ে একটি মিনি জাহাজে রওনা হলাম কোরাল আইল্যান্ডের পথে। সাগরের কিছুদূর গিয়ে প্যারাসেলিংয়ের অফার এলো জাহাজে থাকা যুবকের কথায়। তাতে অনেকে সাঁয় দিলেন। তাদের মিনি জাহাজ থেকে নামিয়ে ছোট স্প্রিডবোটে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো প্যারাসেলিংয়ের জায়গায়। প্রায় আধা ঘণ্টা পর তারা আবারও মিনি জাহাজে ফিরলেন।
আরও পড়ুন: ওয়াকিং স্ট্রিটের অজানা গল্প
পাতায়া সৈকতে উন্নত আকর্ষণ প্যারাসেলিং। তবে প্যারাসেলিংয়ে ভিন্নতা আছে। শুধু আপনাকে ওড়াবে না। সমুদ্রে উড়িয়ে নেওয়ার সময় পানিতে ফেলে গা ভেজানোর পাশাপাশি পানি খাওয়াতে ও ভুলবে না সেই প্যারাসেলিং পরিচালনাকারী ব্যক্তি। তবে প্যারাসেলিং ও সাগরের তলদেশ দেখার বিনোদনে প্রতিদিন তারা নানা অফার দেন।
আমাদের গ্রুপে অন্তত ১০ জনের বেশি গিয়েছিলেন প্যারাসেলিং করতে। তাদের অভিজ্ঞতায় সেটি ছিল অসাধারণ। যদিও আমি ঠাণ্ডার কারণে সেটি করতে পারিনি। এছাড়াও আছে সাগরের পানির নিচের তলদেশে থাকা মাছ, বিভিন্ন সাগরে বসবাসকারী প্রাণী ও বিভিন্ন বিষয় দেখার মতো সুযোগ। এ বিষয়টির জন্যই অনেকে থাইল্যান্ডের পাতায়ায় ছোটেন।
গেল বিচকে আকর্ষণীয় করার বিষয়গুলো। হাঁটা দূরত্বে আবাসিক হোটেলগুলো সেজে আছে আপনাকে স্বাগত জানাতে। আমরা যেদিন হোটেল রয়েল বিচে উঠলাম, সেটির জানালা দিয়ে সৈকতের ভিউ চোখে এসে লাগছিল। ফলে হোটেলে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলেও খাবার শেষে সৈকতে যেতে ভুল হয়নি। তীর ঘেঁষা প্রধান সড়ক। এক পাশে সৈকতের ফুটপাত অন্যপাশে খাবার, খেলনা, জিম, ম্যাসাজ পার্লার আর রেস্তোরাঁয় গিজগিজ করছে। ফলে অন্যরকম এক অনুভূতি।
প্রথম দিন আমরা কয়েকজন মিলে সৈকতের এপাশ ওপাশ ঘুরে বেশ ক্লান্ত। একজন বলে উঠলেন, চলেন ম্যাসাজ করে আসি। শুনলাম, এ শহরে প্রায় কয়েক হাজার ম্যাসাজ পার্লার রয়েছে। যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়ই ম্যাসাজ নিতে পারে।
আরও পড়ুন: ঝকঝকে সৈকতে বালাই নেই কোনো ময়লা-প্লাস্টিকের
শুরুতেই বলেছি কী নেই এই পাতায়ায়। যা চাইবেন তাই আছে। তবে এর জন্য গুনতে হবে বাড়তি টাকা। এই নগরীতে প্রতিটি দোকান, রেস্তোরাঁ আর ক্লাবগুলো পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য সেভাবে সাজানো হয়। আমাদের দেশে ক্লাব বলতে অনেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ও কাবাডিসহ বিভিন্ন খেলার আয়োজন করে যে ক্লাব তাকেই বুঝে। আর অভিজাত ক্লাব বলতে গুলশান বা পাঁচ তারকা হোটেলে বছরে বিশেষ দিনে নাচ গান। কিন্তু এই পাতায়ায় এলে ক্লাব সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটে। চিন্তার জগতে ছেদ পড়বে যে কারো। প্রশ্ন জাগবে নানা বিষয়ে।
পাতায়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন। তারা নানা বর্ণ ও ভাষার। নানা সংস্কৃতির মিশেলে চিন্তার মানুষ তারা। বহু মানুষের মেলবন্ধন আর তাদের আসল ক্লাবের স্বাদ দিতে পাতায়ায় ওয়াকিং স্ট্রিট নামে একটি সড়কই করা হয়েছে। যেখানে সড়কের দুই পাশে গড়ে তোলা হয়েছে বাহারী ক্লাব।
পর্যটকরা খুব সহজে এই শহরে কম টাকায় ঘুরতে পারে। তবে তা প্রাইভেট কারে নয়, টুকটুককেতে। টুকটুক হলো বাংলাদেশের ঢাকার বুকে স্বল্প দূরত্বের রুটগুলোতে দাপিয়ে বেড়ানো অবৈধ লেগুনার মতো। তবে সেগুলো চলে দেশটির কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে। চালকদের লাইসেন্সও আছে। লেগুনার মতো দেখতে হলেও সেগুলো বেশ চকচকে। ঢাকার লেগুনার চালকরা গাড়ি না ভরলে গন্তব্যে ছুটতে চায় না, কিন্তু টুকটুকের চালকরা নির্লোভ। তারা একজন হলেও রওনা শুরু করে।
সহকর্মী আদদান বলছিলেন, টুকটুকে চড়ে বেশ মজা লেগেছে। পাতায়ার তীর ঘেঁষা সড়কের এই পাশ থেকে ওপাশ আবার শহরের বিভিন্ন স্বল্প দূরত্বের পথে বেশ স্বাচ্ছন্দময়। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ বাত। দেশি টাকায় ৩০ এর একটু বেশি।
আরও পড়ুন: কোরাল আইল্যান্ড: দস্যুদের আস্তানায় পর্যটনের হাতছানি
এই শহরে পর্যটকরা মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়েও ঘুরতে পারে। এখানে লোকাল ট্রান্সপোর্ট বলতে ভ্যাসপা মোটরসাইকেল আর মিনি বাস। তবে সেগুলো অত্যাধুনিক। যানজট নেই বললে চলে। কেনাকাটার সময় কোনো বাড়তি দাম নেওয়ার ঝামেলা নেই। ক্ষুধা লাগলে যা খেতে চান তাই পাবেন। সেটা হোক হালাল থেকে হারাম। তবে সব রেস্টুরেন্টে নয়। এজন্য খুঁজে নিতে হবে।
আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেখানকার এক নারী কর্মী বলছিলেন, পাতায়ার সাথে থাইল্যান্ডের যেকোনো শহরে খুব সহজে রোড ও আকাশ পথে যাওয়া যায়। গাড়িও আছে পর্যাপ্ত। বিদেশিরা খুব সহজে মোড়ে মোড়ে থাকা মানি ট্রান্সফারের দোকানগুলো থেকে নিজ দেশের মুদ্রা বা ডলারের বিনিময়ে বাত নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে যখন যা রেট আসে তাই পান গ্রাহকরা। দেশটিতে পর্যটকদের নিরাপত্তায় সারাক্ষণ কাজ করে ট্যুরিস্ট পুলিশ। ফলে এ শহরে চুরি বা ছিনতাই নেই।
সবশেষে একটা বিষয় খুব চোখে ধরেছে। আর তা হলো পর্যটকদের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানোর সহায়তায় নিয়োজিত গাইড। এই পেশার অধিকাংশই নারী। তারা ভাষা ও আচরণে প্রশিক্ষিত। দেশটির সরকার থেকে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত। ফলে তারা পর্যটকরা কোথায় ঘুরবেন, কোথায় কী খাবেন, কোন পথের দূরত্ব কত এবং কখন কোথায় রওনা হতে হবে সব দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তবে তা তারা ফ্রিতে করেন না। যা পরামর্শ দেন সবটাই টাকার বিনিময়।
আমাদের গাইড টুমি জানালেন, দেশটিতে প্রতি বছর দুই কোটির ওপরে পর্যটক শুধু ঘুরতে যায়। যা আগের বছরগুলোর তুলনায় এখন বেড়েই চলেছে।
এমআইকে/এইউ