বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

থাইল্যান্ডে যা দেখলাম-৪

কোরাল আইল্যান্ড: দস্যুদের আস্তানায় পর্যটনের হাতছানি

মোস্তফা ইমরুল কায়েস, থাইল্যান্ড থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১১:২৫ এএম

শেয়ার করুন:

Thailand
ছবি: ঢাকা মেইল

থাইল্যান্ডে যাওয়ার প্রথম দিন অনেকটা ব্যস্ততায় কাটল। তারপর থেকে শুনছিলাম কোরাল আইল্যান্ডের কথা। কয়েকজন সহকর্মী বারবার বলছিলেন- সেই দ্বীপে না কি একসময় দস্যুদের আস্তানা ছিল। যদিও এখন সেই দ্বীপ পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত। যা হোক, যথারীতি সকালের নাস্তা সারলাম আমরা। বাস হোটেল ছেড়ে সাগরের তীরের দিকে ছুটছে। সিটে বসেই ভাবছিলাম কোরাল আইল্যান্ডটি কেমন হবে। সঙ্গে নানা ভাবনা মনে দাগ কাটছিল। তার মাঝেই শহরের বুক চিরে ছুটে চলছিল বাস। রাস্তাগুলো একমুখী। অনেকটা সাপের শরীরের মতো আঁকাবাঁকা। তবে ভিড় নেই। গাড়ির জটও নেই, নেই দ্রুত যাওয়ার তাড়াও। আনমনে এসব দেখতে দেখতেই আমাদের বহনকারী বাসটি পৌঁছে গেল সাগরের তীর ঘেঁষা পোর্টে।

বাস থামতেই নেমে পড়ল সবাই। আমাদের পেছনে সাগরের কোল ঘেঁষে সবুজ পাহাড়। যার মাথায় ইংরেজিতে বড় করে লেখা- পাতায়া সিটি। এটাই কোরাল আইল্যান্ড যাওয়ার পোর্ট বা যেটাকে বাংলায় আমরা জেটি বলে থাকি। যা হোক, বাস থেকে নেমে পুরো টিমের সদস্যরা ব্যস্ত হয়ে গেল ছবি তোলা নিয়ে। সবার ফ্রেম একটাই- পেছনে পাতায়া সিটি লেখা শব্দটি থাকা চাই-ই।


বিজ্ঞাপন


তখন তাপমাত্রার পারদ ছুঁয়েছে ৩৮ ডিগ্রির ঘর, গা অনেকটাই যেন পুড়ে যাচ্ছিল। তবে কোরাল আইল্যান্ড যাওয়ার খুশিতে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। আমাদের সাথে আসা দুই নারী গাইড বারবার তাগাদা দিয়ে চলছেন- প্লিজ কাম, প্লিজ কাম। দ্যা বোট ইজ গোয়িং অন। প্লিজ কাম। তবুও তাদের কথার ফাঁকেই আমরা একঝাঁক বাংলাদেশ থেকে আসা বড় দলটি গ্রুপ ছবি তুললাম। পরে আবার শুরু হলো জাহাজের দিকে ছোটার পালা।

Thailand4

এবার যে যার মতো করে ছুটছে। আমরা জেটিতে চড়ামাত্র আরেক দল ছুটে যাচ্ছিল ঘাটের দিকে। বেশিরভাগ চাইনিজ, কোরিয়ান আর মালয়েশিয়ান টুরিস্ট। তাদের অধিকাংশের হাতে বালিশ, কাপড়ের মোটা ব্যাগ আর নারীদের কাঁধে ছিল ছোট বাচ্চারা। কেউ আবার ট্রলিতে করে ছোট বাচ্চা নিয়েও ফিরছেন। বুঝতে বাকি রইল না তারা সেখানে রাত্রিও যাপন করেছেন। যাই হোক, এসবের মাঝেই হাঁকডাক দিতে দেখা যায় বিভিন্ন এজেন্সির কর্মীদের। তারা ছোট জাহাজ বা স্প্রিডবোটে কোরাল আইল্যান্ডে চুক্তিতে নিয়ে যান। তবে পোর্টে এসে দরদাম করলে কম টাকায়ও প্যাকেজ পাওয়া যায়। এই জেটি ধরে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ছুটে কোরাল আইল্যান্ডে। যে দৃশ্য আপনি চোখে না দেখল বিশ্বাসই করবেন না।

কোরাল আইল্যান্ড ফিরতি টুরিস্টদের ভিড় ঠেলে ছুটলাম জাহাজের দিকে। আবারও পড়ল সেলফি ও ছবি তোলার হিড়িক। গাইড টুমি বলতে লাগলেন- ইফ ইউ নট কাম, সো ইউ ইউল গো এলোন। এবার সবার চেতন ভাঙল। টুমি বললেন- কিছুদূরেই নোঙর করা জাহাজ।


বিজ্ঞাপন


 

আরও পড়ুন

ঝকঝকে সৈকতে বালাই নেই কোনো ময়লা-প্লাস্টিকের

তবে প্রথম দেখায় থমকে গেলাম, এটা তো জাহাজ নয়, ছোট বোট। যাক, হোক। এবার চড়ার পালা। একে একে সকলকে তোলার আগে সিমিয়ান নামে বোটের নারী কর্মী তার মোবাইল আইফোনে এক এক করে সকলকে ক্যামেরা বন্দী করতে লাগলেন। তখনো আমরা আঁচ করতে পারিনি- এই ছবিতে ব্যবসার ধান্দা তার। প্রিন্ট করে আমাদের কাছেই বিক্রি করবে।

 

সকলে ওঠে গেল। সামনে ইঞ্জিন ও চালকের বসার জায়গা। পেছনে কয়েক সারিতে বেঞ্চ বসানো। তাতে বসে গেলেন ভাবী, বাচ্চা ও ভাইয়েরা। তবে কম-বেশি সবার জায়গা হলো বোটে। শুরু হলো যাত্রা। এবার বোটের চালকের সহযাত্রী রনি লাটিয়া বক বক করে নানা নির্দেশনা দিলেন। সেই সাথে নিজেদের পর্যটনের বিজ্ঞাপনও করলেন।

Thailand1

পাতায়া পোর্ট থেকে বোট ছুটে চলছে কোরাল আইল্যান্ডের দিকে। কিছুদূর গিয়ে আমাদের প্যারাসেলিং করার অফার দেওয়া হলো। সেই অফারও লুফে নিলেন অনেক সহকর্মী। তাদের প্যারাসেলিং শেষে আমরা ছুটলাম। এবার বোটের গতি উঠল। তবে ছুটছে একই গতিতে। সাগরের নীল জলরাশি। চারদিক থৈথৈ পানি। জলজ প্রাণী ভেসে উঠছে। নীল পানি পাহাড়ের সবুজের সাথে যেন মিতালী করেছে, এমন রঙ ধারণ করে আছে।

কিছু সময় পর বোটের সামনে থেকে চোখে ভাসল সামনে আবছা দুটি সবুজ পাহাড়। মাঝে উঁকি দিচ্ছে আরেকটি। বোট যত গভীরে ছুটতে শুরু করল, ততই যেন সাগর উত্তাল হয়ে উঠছে। ভয়ও লাগছে বেশ। কিন্তু চোখ জুড়ানো নীল জলরাশির সৌন্দর্য অনেকটা ভয় কাটিয়ে দিচ্ছে। সাগরের ঢেউ বারবার বোটে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। ধীরে ধীরে ঢেউ কমতে থাকল। স্থির গতিতে ছুটছে বোট। একসময় চোখের সামনেই ধরা দিল কোরাল আইল্যান্ডের চেহারা। তার পাশেই সহযাত্রী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরও কয়েকটি দ্বীপ। সেগুলোতেও আছে মানুষের যাতায়াত।

 

আরও পড়ুন

হর্ন বাজানোকে অপরাধ মনে করেন চালক!

প্রায় ৪৫ মিনিট পর আমরা পৌঁছে গেলাম কোরাল আইল্যান্ডের জেটিতে। বোট ভিড়ল জেটির সিঁড়িতে। নেমে পড়লাম সকলে। এবার যে যার মতো ছুটলাম কোরালের বিচে। যেতে যেতে ভাবছিলাম, কোরাল পাথর আর পাহাড় নিয়ে কত সুন্দর এই দ্বীপ। দূর থেকে তীরে পর্যটকদের গোসল করার দৃশ্য চোখে ধরছে। আরও চোখে পড়ল জেটস্কি আর বানানা বোট রাইডিংয়ে চড়ে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য। আর পাহাড়ে উঠলেই দেখতে পাবেন বুদ্ধের স্ট্যাচু। যা সবার নজর কাড়ে।

 

Thailand

জেটি পার হতে হয় কোরাল পাহাড়ে কোল ঘেঁষে। যার আশপাশে পড়ে আছে কোরাল পাথর। এক একটির বয়সও অনেক। প্রায় এক কিলোর পথ হেঁটে পৌঁছে গেলাম কোরাল আইল্যান্ডের পাহাড়ের নিচে থাকা বিচে। এই বিচকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন খাবারের দোকান। প্রতিটি দোকানে এসি আর বিদ্যুৎ রয়েছে। আরও আছে রকমারি ঠাণ্ডা গরম ও সি ফুড। পরে জানতে পারলাম দেশটির সরকার সেখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেই বিদ্যুতে চলে পুরো কোরাল বিচের প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

আরও জানলাম, এই বিচে ঘোরার জন্য মোটরসাইকেলও ভাড়া দেওয়া হয়। পর্যটকরা মাত্র ৩০০ বাথে সেগুলো নিতে পারেন। ঘোরা যায় সারাদিন। দিনশেষে আবারও সেগুলো জমা দিতে হয় কর্তৃপক্ষকে। সঙ্গে আরও সুবিধা আছে, দুই থেকে তিন জন অনায়াসে গলফ কার ভাড়া নিয়ে দাপিয়ে ঘোরা যায় দ্বীপটির এপাশ থেকে ওপাশ। ইচ্ছেমতো মোটরসাইকেল ভাড়ায় নিয়ে পাহাড়েও উঠতে পারেন যে কেউ। এছাড়াও বিচে দেড়শ বাথে (৪৫০ টাকার বেশি) মিলছে চেয়ার ও ছাতার নিচে আরামের জায়গা।

 

আরও পড়ুন

আজও মধুর বাঁশরী বাজে

রোদে অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠে বসে গেলাম সেগুলোর নিচে। তবে বাথে নয়, ফ্রিতে। এরই মাঝে কয়েকজন ‍যুবক এলেন কচি সবুজ ডাব নিয়ে। এক একটি দাম পড়ল ৫০ বাথ। ডাবের পানির চুমুকে অনেকটা ক্লান্তি দূর হলো। কিছুক্ষণ পর এলো আনারস, তরমুজ ও পেয়ারাসহ আরও কিছু ফলের প্যাকেজ। ওদিকে লবণাক্ত পানিতে ইতোমধ্যে নেমে গেছেন আমার সহকর্মীরা। কেউ কেউ নামার প্রস্তুতিতে। সহকর্মী বায়েজিদ আহমেদ বারবার পানিতে নামার তাগাদা দিচ্ছিলেন। পরে নেমেই পড়লাম। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না, সকলে ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে।

 

একপর্যায়ে কথা হলো ভারতের গোয়াহাটি থেকে আসা পর্যটক সুধিন্দু’র সাথে। তিনি জানালেন, তারা ২৫ জন বন্ধু এসেছেন। সাথে পথেও আরও কিছু ভারতীয়দের পেয়েছেন। তাদের ভাষ্য, যে টাকায় সিঙ্গাপুর যাব, সেই টাকায় যদি থাইল্যান্ডের কোরালে আসা যায়, তবে কেন আসব না।

বিচটিতে একটি জিনিস খুব চোখ ধরল। তা হলো কোনো ময়লা পড়ার সাথে সাথেই একদল ক্লিনার কর্মী এসে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন জাগল এসব ময়লা তারা কোথায় ফেলে সাগরে, নাকি পুঁতে ফেলে? পরে সহকর্মী ইমরুল কাওসার ইমন জানালেন, দেশটির সরকার এ দ্বীপটি পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পাতায়া থেকে পাইপলাইন টেনে নিয়ে গেছে সেখানে। সেখানে যতো ময়লা জমে সবটাই তারা পাইপে করে মেশিনের সাহায্যে টেনে পাতায়া শহরে নিয়ে যায়। এছাড়াও দেশটির সরকার এই কোরাল আইল্যান্ডে পর্যটকদের জন্য যাবতীয় সুবিধা রেখেছে। যাতে কেউ বিমুখ না হয়।

প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ডুবার আগ মুহূর্ত পর্যটকে গিজগিজ করে কোরাল আইল্যান্ড। দিনব্যাপী চলে পর্যটকদের জলকেলি। তবে কেউ যাতে গভীর সাগরে যেতে না পারে তার জন্য লাল, সবুজ ও নীল বল এবং প্লাস্টিকের ড্রামের চেইনে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। ভাগ ভাগ করে চলে প্রতিটি আনন্দ বিনোদন দেওয়ার ব্যবসা। জেটস্কি এখানে চরম জনপ্রিয়। বিশেষ করে উঠতি যুবক থেকে শুরু করে বয়স্করাও চষে বেড়ান এতে।

 

আরও পড়ুন

ওয়াকিং স্ট্রিটের অজানা গল্প

ওদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে। ফেরার তাগাদা দিতে থাকলেন গাইড টুমি। আমরাও সকলে কোরাল বিচকে বিদায় জানিয়ে ওঠে গেলাম বোটে। পরে বোট নীল জলের গা মাড়িয়ে ছুটল পাতায়ার পোর্টের দিকে। তবে আগের চেয়ে এবার সময়টা বেশ অল্প মনে হলো। ফেরার পথে ভাবছিলাম, একটি কোরাল দ্বীপকে কতভাবে পর্যটকদের পছন্দনীয় করা যায়, কত সুবিধা থাকলে তা হয়ে ওঠে পর্যটনকেন্দ্র। এসব ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম পাতায়ার পোর্টে।

নেমেই দেখি জেটিতে ভিড়। সমানে এগোতেই দেখি, বোটে ওঠার সময় আগের তোলা ছবিগুলো প্রিন্ট ও লেমেনেটিং করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি দাম হাঁকানো হয়েছে সাড়ে তিনশ থেকে চারশ বাথ। অনেকে সেই ছবি কিনলেন। কেউ আবার গা ছাড়া ভাব নিয়ে ওঠে বসে পড়লেন বাসে। প্রচণ্ড রোদে গরম ছিল চরমে। পোর্টে ২০ বাথে আইসক্রিম পেয়ে তো অনেকে মহাখুশি। বড়-ছোট আইসক্রিম কিনে মুখে নিতে নিতে বাসে উঠল তারা। বাস ছুটল আবারও হোটেলের দিকে।

এমআইকে/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর