শহরে সারাদিন গাড়ি চলে। অলিগলি, সড়ক থেকে মহাসড়ক। আছে হালকা যানজটও। তবে যাই ঘটুক কেন, হাজার হাজার গাড়ি চললেও হর্ন কানে বাজে না। এ যেন বোবা হর্নের শহর। কেউ কি ভুলে নাকি হর্ন বাজালে কল্লা যাবে- এমন ভয়ে হর্ন দেন না! পথচারী ক্রস করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, অন্যদিকে দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে গাড়ি, কিন্তু এসেই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। পথচারীর রাস্তা পার হওয়া শেষ হলেই চালক গাড়ি টানেন।
কী, অবাক হচ্ছেন শুনে! যারা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বা অন্য কোনো বড় শহরে থাকেন তাদের কাছে এমন গল্প অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু টানা পাঁচ দিন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডের রাস্তাঘাট, পার্ক, মহাসড়ক ও বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, থাইল্যান্ডের কোনো এলাকাতেই কেউ হর্ন দেন না। খুব প্রয়োজন হলে তা খুব মৃদু শব্দে। আর হর্ন বাজানোকে এ দেশের মানুষ অসভ্যতা মনে করে।
পাতায়া শহরে টানা তিন দিন আমাদের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরে দেখিয়েছে গাইড টুমি। শেষ দিনে তার সাথে কথা হচ্ছিল। তাকে প্রশ্ন করলাম- তোমরা চলার পথে গাড়ির হর্ন ব্যবহার করো না কেন? আমার প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হলেন টুমি। তারপর বললেন, কেন দেব! এটাতো অপরাধ।
টুমির কথাটা তেমন মনে ধরল না। এবার আমাদের বহনকারী বাসের চালককে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কেন হর্ন দাও না? তিনিও জানালেন একই কথা। পরে আরও অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেল, আসলে থাইল্যান্ডে গাড়ির হর্ন বাজানোকে তারা অপরাধ মনে করেন।
বিজ্ঞাপন
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে খানিকটা দূরে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্স মাহিদল দেখতে বের হয়ে ধারণা আরও বদলে গেল। বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত একটি ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে আমরা ঘুরলাম। কিন্তু সেই চালক একটিবারও হর্ন বাজালেন না। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যেতে পথে কয়েকবার গাড়ির জটে পড়তে হয়েছে৷ কিন্তু গাড়ি থামেনি। টানা ছুটে চলেছে। যাওয়ার সময় আমাদের বহনকারী গাড়িটি পথে ইউটার্ন নিতে দাঁড়ায়। ওই সময় পেছনে থাকা গাড়িটি আমাদের বহনকারী গাড়ির বাঁক না নেওয়া পর্যন্ত থমকেই ছিল। কিন্তু কোনো হর্ন বাজায়নি।
বিরক্ত হয়ে হর্ন বাজাল চালক!
পাতায়া থেকে টানা পাঁচ ঘণ্টার জার্নি। সবার শরীর অনেক ক্লান্ত। হোটেল রয়েল বেনজায় পৌঁছে অনুভব করলাম পেট ক্ষুধার জ্বালায় ছু ছু করছে। এর মধ্যে অনেকে দুপুরের খাবার সেরেছেন। আমরাই ছিলাম শেষ টিম। হোটেল থেকে হাঁটা দূরত্বের লোকাল রাস্তা ধরে আমরা হাঁটছিলাম। অনেকের গা-ছাড়া ভাব। এরই মধ্যে পেছনে চোখে পড়ল দুটি প্রাইভেটকার এসে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি দুটির সামনে দিয়ে আমাদের কয়েকজন রাস্তা পার হচ্ছেন। কিন্তু তারা জমিদারি স্টাইলে রাস্তা পার হচ্ছেন। যেন কোনো বড় হাতি হাঁটছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিল সেই গাড়ি দুটি। আমরা ভাবছিলাম- কী ব্যাপার গাড়ি দুটি থমকে গেল কেন! এখানেই কি তাদের শেষ পথ ছিল! কিন্তু না। এমন চিন্তার ছেদ পড়ল হঠাৎ একটি মৃদু হর্নের শব্দ শুনে। এবার আমাদের সবাই সেই চালকের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। যেন তারা কোনোদিন হর্নই শোনেনি। আসল ঘটনা হলো- সবাই টানা পাঁচ দিন এই দেশে অবস্থানকালে কোনো হর্ন শোনেনি। ব্যাংককে এসে হঠাৎ হর্ন শুনলো তারা। আমাদের মাঝে একজন তো বলেই উঠলো- চালক কিন্তু খুব বিরক্ত হয়েছিল। রাগ করেই হর্ন দিয়েছে।
পাতায়া শহরে টানা তিন দিন আমাদের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরে দেখিয়েছে গাইড টুমি। শেষ দিনে তার সাথে কথা হচ্ছিল। তাকে প্রশ্ন করলাম- তোমরা চলার পথে গাড়ির হর্ন ব্যবহার করো না কেন? আমার প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হলেন টুমি। তারপর বললেন, কেন দেব! এটাতো অপরাধ।
অবশ্য চালকের মৃদু হর্ন দেওয়ার কারণও জানা গেল অবশেষে। তারা নাকি হর্ন দেওয়াকে বড় অপরাধ মনে করেন।
শহরটিতে প্রায় দেড় দশক ধরে থাকেন কলকাতার শুভাষ রায়। সেখানে বিয়ে করে সেটেল। তার সাথে ব্যাংককের শুকুমভিত এলাকার একটি সুপার শপে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন, এখানে আপনি গাড়ির হর্ন শুনবেন না। আর শুনলেও সেটা আপনার আমার কারণে। তবে কদাচিৎ। কারণ হিসেবে ভারতীয় এই নাগরিক বললেন, বিশেষ করে হর্নে অভ্যস্ত দেশগুলো থেকে আসা লোকজন রাস্তা পারাপারের সময় নানা ঘটনা ঘটায়। এই যেমন গাড়ি দেখে থেমে যায়, রাস্তা পার হবে কি হবে না এটা দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। আবার কেউ কেউ ভাবে বিদেশে এসেছি, এখানে তো আর গাড়ি পিষে যাবে না, তাই ধীরেসুস্থে রাস্তা পার হই। কিন্তু ওই সময়টুকুর জন্য অপেক্ষায় থাকেন চালক। এতেও পার না হওয়ায় অথবা কেউ বেখায়ালে রাস্তা পার হলে তাকে সতর্ক করতে চালক মৃদু হর্ন বাজায়।
জানা গেছে, থাইল্যান্ডের কোনো এলাকাতেই কেউ হর্ন দেন না। খুব প্রয়োজন হলে তা খুব মৃদু শব্দে। আর হর্ন বাজানোকে এ দেশের মানুষ অসভ্যতা মনে করে।
সেই সুপারশপ থেকে বের হয়ে শুকুমভিতের একটি লোকাল রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিষয়টি জানার চেষ্টা করলাম। ঠিকই তো! পথচারী রাস্তা পার হচ্ছে দেখলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো। এ যেন অবনত হয়ে অনুগতের বহিঃপ্রকাশ।
সব মিলে থাইল্যান্ডে যে কদিন থেকেছি দেশটির ব্যাংকক ও পাতায়া শহরে কোনো হর্ন কানে ভাসেনি। এ যেন নিস্তব্ধ হর্নের শহর। বারবার মনে হচ্ছিল- এ শহরে কী যেন কানে বাজছে না!
পাতায়ার ক্রোকোডাইল ফার্ম হয়ে ব্যাংকক শহরে আসার পথে হাইওয়ে পড়ে। কিন্তু দীর্ঘ এই পথে চালকের পাশে বসে থেকে লক্ষ করেছি, কোনো গাড়ি হর্ন দিচ্ছে না। সামনে থাকা গাড়ির চালক তার লুকিং গ্লাসে পেছনে থাকা গাড়িকে সাইট দিচ্ছে। তারা যেন সবাই সবার মনের ভাষা বোঝে। প্রতিটি গাড়ি লেন ধরে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে। কিন্তু কারো থেকে হর্নের শব্দ এলো না।
এমআইকে/জেবি