images

আন্তর্জাতিক

হুথিদের সামরিক শক্তি কেমন, ইয়েমেন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০১:৩১ পিএম

বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর একটি ইয়েমেন ২০১৪ সালে শিয়া মুসলিম গোষ্ঠী হুথি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা দখল করে নেয়ার পর থেকে গৃহযুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। এরপর হুথিদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর আকাশ পথে হামলা আরও বেশি ধ্বংস ও দারিদ্র্যতা ডেকে এনেছে।

তারপরও হুথিরা গত নভেম্বর থেকে সাগরপথে পণ্য পরিবহনের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে এবং এখন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের উপর পাল্টা হামলা করছে। এই সংঘাত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।

ইয়েমেনের অবস্থান কোথায় এবং এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেন?
হুথিরা যে সাগরে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠেছে, এর পেছনে তাদের বড় শক্তি হলো তারা যে অঞ্চলটা নিয়ন্ত্রণ করে সেটার অবস্থান। ইরান সমর্থিত হুথিরা ২০১৪ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে ইয়েমেনের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। যার মধ্যে আছে রাজধানী সানা, দেশটির উত্তর অংশ এবং লোহিত সাগরের উপকূল অঞ্চল।

আরও পড়ুন: কেন শুরু হয়েছিল ইয়েমেন যুদ্ধ, কে কার প্রতিপক্ষ?

এটা তাদের লোহিত সাগরের প্রবেশপথ হিসেবে খ্যাত বাব আল-মানদাব প্রণালির নিয়ন্ত্রণ দেয়, যা ইউরোপের সাথে এশিয়ার যোগাযোগের সংক্ষিপ্ততম পথ এবং এটি তাদের অস্ত্রের আওতার ভেতরে।

হুথিরা কেন জাহাজে হামলা করছে?
ইউএস মিলিটারি সেন্ট্রাল কমান্ডের হিসেবে, ১৯শে নভেম্বর ২০২৩ থেকে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা দক্ষিণ লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের মধ্যে পণ্য পরিবহনকারী জাহাজগুলোতে কমপক্ষে অন্তত ২৬টি হামলা করেছে।

হুথি জানিয়েছে, এই হামলাগুলো তারা করেছে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে। তারা বলছে যে সমস্ত জাহাজের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক আছে তারা সেসব জাহাজকেই লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।

আরও পড়ুন: হুথি দমনে লোহিত সাগরে কেন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে নেই চীন?

কিন্তু সমালোচকরা বলছেন সাম্প্রতিক সময়ে যেসব জাহাজে তারা হামলা করেছে সেসব অনেকগুলোর সাথে ইসরায়েলের কোন সম্পর্কই নেই। তারা বলছে হুথিরা আসলে গাজার বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে, নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করছে এবং ইরানের কাছে প্রমাণ দিচ্ছে যে তারা তাদের কার্যকরী মিত্র হিসেবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

হুথিদের সামরিক সক্ষমতা কেমন?
লোহিত সাগরে জাহাজে হুথিদের সাম্প্রতিক হামলায় দেখা গেছে তারা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন (ইউএভি) ও চালকবিহীন জাহাজ (ইউএসভিস) ব্যবহার করেছে। এছাড়া শুরুর দিকে হামলায় দেখা যায় হুথিরা ছোট ছোট নৌকা বা হেলিকপ্টার নিয়ে বড় জাহাজে উঠে পড়ছে এবং সেটা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।

ইউএভি বা তথাকথিত “কামিকাজে ড্রোন”- যেটা হুথিরা ব্যবহার করছে, ধারণা করা হচ্ছে এগুলো কাসেফ ড্রোন, সেই সাথে আছে অনেক দূর পর্যন্ত হামলায় সক্ষম সামাদস যুদ্ধবিমান- লেজের দিকে যেটায় ভি আকৃতির পাখা থাকে। এই অস্ত্র হুথিরা ব্যবহার শুরু করে আসছে সৌদি আরবের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের সংঘাতে।

দ্য ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি বলছে, বিভিন্ন ধরনের জাহাজ বিধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে হুথিদের, যেগুলো ৮০ কিলোমিটার থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। এর মধ্যে আছে সায়াদ এবং সেজ্জিল মিসাইল।

আরও পড়ুন: ইসরায়েলি জাহাজে হামলার হুমকি হুথিদের

এই থিঙ্কট্যাঙ্ক মনে করে, হুথিদের কাছে এমন জাহাজ বিধ্বংসী ব্যালিস্টিক মিসাইলও আছে যা ৩০০ কিলোমিটার দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এই মিসাইলগুলোর অবস্থান নির্ণয় করাও কঠিন কারণ তারা খুব দ্রুতগতির হয় এবং মূহুর্তের মধ্যে আক্রমণ করতে পারে। তবে এর জন্য দরকার হয় ড্রোন, অন্য জাহাজ বা অস্ত্রের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে বিশদ তথ্য।

সমুদ্রের ইতিহাসবিদ সাল মারকোগলিয়ানো বলেন, ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ এই দুই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রই ড্রোনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, কারণ তাদের সাথে বড় যুদ্ধাস্ত্র থাকে এবং আরও বেশি গতিশক্তি থাকে। একমুখী ড্রোনগুলো সংখ্যায় অসংখ্য কারণ এগুলো খুবই সস্তা এবং সহজেই ব্যবহার করা যায়, তবে একটু ধীরগতির। এই ড্রোনগুলো ঠিক পানির উপর জাহাজের ভেসে থাকা জায়গা বরাবর আঘাত করে এবং তা থেকে আগুন ধরে যাওয়াটা হল সবচেয়ে দুশ্চিন্তার।

তবে মারকোগলিয়ানোর বিশ্বাস ‘সবচেয়ে ভয়ের’ হল ইউএসভিস বা চালকবিহীন জাহাজ, কারণ এটি পানির উপরে জাহাজে আঘাত করে, যার মাধ্যমে এটি ফুটো হয়ে ভেতরে পানি ঢোকে এবং জাহাজটি ডুবে যায়। ইউএস নেভি বলছে, চলমান সংঘাতে হুথিরা প্রথম এই চালকবিহীন জাহাজটি বিস্ফোরণ সহকারে ব্যবহার করে গত ৪ই জানুয়ারি এবং সেটি জাহাজ চলাচলের আন্তর্জাতিক লেনে এসে বিস্ফোরিত হয়।

আরও পড়ুন: হুথি হামলা লোহিত সাগরে, জার্মানিতে বন্ধ টেসলার কারখানা!

ইউএস নেভি কমান্ডার ভাইস অ্যাডমিরাল ব্রাড কুপার বলেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে কোন হতাহত হয়নি বা কোন জাহাজকেও এটি আঘাত করতে পারেনি। কিন্তু এই একমুখি ইউএসভিস ব্যবহারের সূচনাটা চিন্তার কারণ। এরকম আক্রমণ তাদের সক্ষমতা সম্পর্কে জানান দেয়।’

সৌদি সরকার জানিয়েছে, হুথিরা এই এইএসভিস প্রথম ব্যবহার হয় ২০১৭ সালে জানুয়ারিতে সৌদি বাহিনীর আল-মদিনার উপর একটা হামলায়। এরপর ২০২০ সালে মার্চে এডেন উপসাগর দিয়ে একটা তেলবাহী জাহাজ ইয়েমেন যাওয়ার পথে সেটার উপর হামলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালায় তারা।

হুথিদের সাহায্য করে কারা?
হুথিরা ইরানের দ্বারা সমর্থিত এবং তারা নিজেদের তথাকথিত 'এক্সিস অফ রেসিসট্যান্স' বা প্রতিরোধ বলয়ের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে আছে লেবাননের হেজবুল্লাহ, সিরিয়ার আসাদ সরকার, গাজায় হামাস এবং ইরান সমর্থিত অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতিপক্ষ শক্তি।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্য সরকার জানায় তারা জাতিসংঘের কাছে এমন প্রমাণ উত্থাপন করেছে যা ইরানের সাথে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপর হামলায় হুথিরা যে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ব্যবহার করেছিল তা চোরাচালানের একটা সংযোগ পাওয়া যায়।

যুক্তরাজ্য সরকার জানিয়েছে, দ্য রয়্যাল নেভি শিপ এইচএমএস মনট্রোজ ২০২২ সালের শুরুর দিকে দুইবার ইরানিয়ান অস্ত্র জব্দ করে যা স্পিডবোটে করে দক্ষিণ ইরানের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় চোরাচালানকারীরা বহন করছিলো।

আরও পড়ুন: হুথিদের হামলার ভয়ে শিপিং কোম্পানিগুলো এখন কী করছে?

তারা বলছে, এসব আটককৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল স্থল থেকে আকাশে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের ইঞ্জিন এবং একটা নজরদারিতে ব্যবহৃত একটি বাণিজ্যিক কোয়াডকপ্টার ড্রোন।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে হামলা কি হুথিদের থামাতে পারবে?
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আরও প্রায় এক ডজন দেশ হুথিদের হামলা বন্ধ করার জন্য সতর্ক করে আসছে।

গত ডিসেম্বরে তারা মিলিতভাবে একটা বাহিনী গঠন করে যার নাম অপারেশন প্রোসপারিটি গার্ডিয়ান মূলত এডেন উপসাগর ও দক্ষিণ লোহিত সাগরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই বাহিনীর লক্ষ্য।

গত ১১ই জানুয়ারি রাতে এই যৌথ বাহিনী পাল্টা হামলা করে। ইউএস এয়ার ফোর্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের সাথে মিলে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী অধ্যুষিত ১৬টি জায়গায় অন্তত ৬০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।

কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন কয়েক বছর ধরে সৌদি আরব ও তাদের মিত্রদের বিমান হামলা হুথিদের কখনোই পুরোপুরিভাবে পরাজিত করতে পারেনি।

সূত্র: বিবিসি

একে