বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

কেন শুরু হয়েছিল ইয়েমেন যুদ্ধ, কে কার প্রতিপক্ষ?

আবুল কাশেম
প্রকাশিত: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৩১ পিএম

শেয়ার করুন:

কেন শুরু হয়েছিল ইয়েমেন যুদ্ধ, কে কার প্রতিপক্ষ?

ইয়েমেনে ২০১৪ সাল থেকে যুদ্ধ চলছে। সেখানকার শিয়া মতাদর্শের হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা সমর্থিত সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট। দীর্ঘ সময় চলার পর অবশেষে যুদ্ধবিরতির দিকে এগোচ্ছে দুই পক্ষ। চলুন জেনে নেওয়া যাক, হুথি বিদ্রোহী কারা? কেন শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ এবং এখানে কে কার প্রতিপক্ষ?

ইয়েমেনি সংকট শুরু হয় মূলত ২০১১-১২ সাল থেকে, যখন দুই দশক ধরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকা আলী আবদুল্লাহ সালেহকে অপসারণের জন্য আন্দোলনের সূচনা হয়। এরপর ক্ষমতা ত্যাগ করেন সালেহ। তখন সরকার গঠন করেন সালেহের সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান মানসুর হাদি।


বিজ্ঞাপন


মানসুর হাদি আরব উপদ্বীপের আল কায়দা এবং হুথি বিদ্রোহী উভয় পক্ষের হুমকিকে মোকাবেলা করতে চেয়েছিলেন। দেশটির উত্তরাঞ্চলে একচেটিয়া সমর্থন থাকায় কয়েক বছর ধরেই বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছিল হুথিরা। হুথিদের আনুষ্ঠানিক নাম আনসারুল্লাহ। স্থানীয়ভাবে তাদের হুথি বলে ডাকা হয়। তারা মূলত শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী।

yemen war

মূলত ১৯৯০ সালের আগে এটি দক্ষিন ও উত্তর ইয়েমেন নামের দুটি রাষ্ট্র ছিল। উত্তর হলো শিয়া প্রধান এবং দক্ষিণ হলো সুন্নি প্রধান। ১৯৯০ সালে দুই ইয়েমেন এক হলেও এর গভীর বিভাজন চলমান ছিল।

নতুন প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদিকে বিদ্রোহীদের পাশাপাশি দরিদ্র এবং খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছিল। এই দুর্বলতার সুযোগে ইয়েমেনের শিয়া নেতৃত্বের হুথি আন্দোলনের কর্মীরা ২০১৪ সালে সাডা প্রদেশ এবং আশেপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর বিদ্রোহীরা সানা অঞ্চলেরও নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়। যুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ নেয় ২০১৫ সালের মার্চে, যখন সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হামলা শুরু করে।


বিজ্ঞাপন


জাতিসংঘের এক হিসাবে, ইয়েমেন যুদ্ধে ৩ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ মারা গেছে যুদ্ধের কারণে ঘটা খাদ্যাভাব ও রোগের কারণে। 

পরের মাসে দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর এডেন থেকে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট হাদি। হুথি আর নিরাপত্তা বাহিনীগুলো সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহের প্রতি অনুগত। এরপর তারা পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে। তাদের পেছনে ইরান সমর্থন জোগায় বলে ধারণা করা হয়। এক পর্যায়ে হাদি দেশের বাইরে পালিয়ে যান।

কিন্তু হাদিকে ইয়েমেনে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে সৌদি আরব আর অন্য আটটি সুন্নি দেশ একজোট হয়ে ইয়েমেনে অভিযান শুরু করে। এই জোটকে লজিস্টিক আর ইন্টেলিজেন্স সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স।

yemen war

বছরের পর বছর ধরে চলা এই লড়াইয়ে দুই পক্ষই পর্যুদস্ত। একটি যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘের তিনটি সংস্থার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। চারমাসের লড়াইয়ের পর সরকারপন্থী বাহিনী এবং দক্ষিণাঞ্চলের সুন্নি উপজাতীয় গোত্রগুলো বিদ্রোহীদের এডেনে আসা ঠেকিয়ে দেয়। ২০১৫ সালের আগস্টে তারা এডেন থেকে হুথিদের তাড়িয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট হাদি নির্বাসনে থাকলেও, তার সরকার অস্থায়ীভাবে এডেনে কার্যক্রম শুরু করে।

তবে হুথিরা সানা এবং টিয়াজে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে এবং সেখান থেকেই সৌদি আরবে মর্টার আর মিসাইল ছুড়েছে। দুপক্ষের এই বিরোধে সুযোগ নিচ্ছে আল কায়েদা ইন দি আরব পেনিনসুলা আর ইসলামিক স্টেট গ্রুপ। তারা দক্ষিণে বেশ কিছু স্থান দখল করে নিয়েছে।

কৌশলগতভাবে ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটি বাব আল-মানদেবের ওপর বসে আছে, যা রেড সি আর গালফ অফ এডেনের সংযোগস্থল। এখান থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের সরবরাহ হয়ে থাকে।

২০১৭ সালে নভেম্বরে রিয়াদে ইয়েমেনের মিসাইল পড়ার পর দেশটির চারদিকে অবরোধ জোরালো করে সৌদি আরব। তবে জাতিসংঘ বলছে, এর ফলে ইয়েমেনে কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ দেখা দিচ্ছে।

জাতিসংঘের এক হিসাবে, ইয়েমেন যুদ্ধে ৩ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ মারা গেছে যুদ্ধের কারণে ঘটা খাদ্যাভাব ও রোগের কারণে। গত নভেম্বরে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে তারা ধারণা করে, ইয়েমেন যুদ্ধ ও যুদ্ধসংশ্লিষ্ট কারণে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।

yemen war

৩ কোটি জনবসতির (২০২০ সালের হিসাব) ইয়েমেনে বর্তমানে ৫০ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। আর ৫০ লাখ মানুষ এই দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফও)। পাশাপাশি সংস্থাটি বলছে, দেশটির মোট জনসমষ্টির ৪৫ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

ইয়েমেনে গত বছর পর্যন্ত ৪০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ সুন্নি এবং ৪৩ শতাংশ শিয়া মতাদর্শী।

আরও পড়ুন: ইয়েমেনে ফিরবে কি শান্তির ভোর?

ইয়েমেনের এই সংকটকে সৌদি আরব আর ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াই হিসাবেও দেখা হয়। কৌশলগতভাবে ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটি বাব আল-মানদেবের ওপর বসে আছে, যা রেড সি আর গালফ অফ এডেনের সংযোগস্থল। এখান থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের সরবরাহ হয়ে থাকে।

আট বছর ধরে চলা ইয়েমেন যুদ্ধ অবশেষে বন্ধ হওয়ার একটি উপলক্ষে এসে পৌঁছেছে। এ নিয়ে ওমানের মধ্যস্ততায় হুথি বিদ্রোহী ও সৌদি আরব কাজ করছে। ইয়েমেনের রাজধানী সানায় এক টেবিলে বসেছে সব পক্ষ। আশা করা হচ্ছে ঈদের আগেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। বাকি আলোচনা চলতে থাকবে।

yemen war

সৌদি আরব ও ওমানের প্রতিনিধিরা রোববার ইয়েমেনের রাজধানী সানায় হুথি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। যুদ্ধ শুরুর পর এমন সফর ও আলোচনা ঐতিহাসিক। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইরান চীনের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তিতে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হওয়ার পর শান্তি উদ্যোগগুলো গতি পেয়েছে।

একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর