বিনোদন ডেস্ক
২৮ মে ২০২৫, ০৩:৪৭ পিএম
কণ্ঠের মুর্ছনায় ছুয়ে গেছেন কোটি বাঙালির হৃদয়। রবীন্দ্র সংগীত কণ্ঠ তুলে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন মুর্শিদাবাদের মেয়ে শিরিন সোরাইয়া। ছোটবেলা থেকে সংস্কৃতি আবহে বেড়ে উঠেছেন। তার সংগীত যাত্রা শুরু হয় হিন্দুস্তানি ধ্রুপদী সংগীত দিয়ে। সংগীত যাত্রার নানা গল্প তুলে ধরেছেন ভারতীয় গণমাধ্যমে।
মাত্র কয়েক বছরেই শিরিন নামটা সংগীত জগতে একটি উজ্জ্বল নাম। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে আপনার রবীন্দ্র সংগীতের ভক্ত ও অসংখ্য শ্রোতা আশ্চর্য হবার মতো। এটা কীভাবে সম্ভব হল?
খুব ছোটবেলা থেকে সংগীতচর্চা করলেও ২০২২ সালে আমি সিরিয়াসলি সংগীত জগতে প্রবেশ করি। বিশেষ করে যখন মারণব্যাবি করোনা এলো, আমিও ভেবেছিলাম আর বাঁচব না। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম চলে যখন যেতেই হবে কমপক্ষে আমার গাওয় গানগুলো রেখে যাই। সারাদিন ঘরবন্দি সময়টা ভালোভাবে কাজে লাগালাম। স্মার্ট ফোনে রেকর্ডিং, মিক্সিং, এডিটিং সবই শিখে নিলাম। তারপর ঘরোয়াভাবে রেকর্ডিং করে পোস্ট করলাম নিজের গান।
মোশাররফ করিমের ছাত্রী ছিলেন সংগীতশিল্পী কনা
প্রথম গানে অদ্ভুতপূর্ব সাড়া পেয়ে আমি দারুণভাবে সাহস ও উৎসাহ পেলাম। মনে হল আমার দায়িত্ব যেন বেড়ে গেল। তারপর বাড়িতেই রেকর্ডিং করে পোস্ট করলাম একের পর এক সংগীত। আমি পোস্ট করতে থাকলাম, আর দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখাল শ্রোতারা। এভাবেই শুরু হলো আমার শিক্ষকতার পাশাপাশি সংগীত শিল্পীর সম্মান পাওয়া। আমি সমাজে একটু একটু করে পরিচিতি পেলাম।

আপনার ছোটবেলায় একটু ফিরে যাই। আপনার পরিবারে কে কে আছেন ?
পরিবারে আমি, আমার স্বামী ও আমার একমাত্র কন্যা থাকি কলকাতায়। আমার জন্মস্থান মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর। সেখানে বর্তমানে আমার মা থাকেন। কয়েক বছর আগে বাবা ইন্তেকাল করেছেন। আমার একমাত্র ভাই পেশাগত কারণে বাইরে থাকেন। আমার বাবা-মা দুইজনেই স্কুল শিক্ষক ছিলেন। আমার স্বামী একজন চিকিৎসক। আমি নিজেও শিক্ষকতা করি ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। আর আছে আমার প্রিয়কন্যা টিমটিম। ক্লাস ফাইভে পড়ে। সে আমার সমস্ত ভাবনায়, আমার সবকিছু জুড়ে। সব জায়গায় আমি তার নাম বলি, আমিও চাই সংগীত জীবনে অনেক এগিয়ে যাক টিমটম।
প্রথমদিকে পরিকল্পনা ছিল সংগীতশিল্পী হব: হিমি
গান শেখার পেছনে কার উৎস বেশি ছিল?
আমার বাবা-মা দুইজনেই গান শেখার জন্য উৎস দিয়েছেন। যখন আমরা দুই ভাই বোন স্কুলে পড়তাম তখন সেই ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার সঙ্গে গান, তবলা, অভিনয় সবই ছিল। সেই সব বিষয়ে আমার বাবা-মা'ই ছিলেন প্রধান উৎসাহদাতা। স্কুল কলেজের সব অনুষ্ঠানে আমরা অংশগ্রহণ করতাম। আমি গাইলে ভাই তবলা বাজাত। ভাই গান গাইলে আমি বাজাতাম। গান বাজনা বাবা বেশি ভালোবাসতেন। তবে পরিবারের সবাই শিক্ষার ওপর জোর দিতেন বেশি। যেটা আমাকে শেষ পর্যন্ত স্থিতিশীল শিক্ষকতার জীবন দিয়েছে। এটাতে অবশ্যই আমি গর্বিত ও আনন্দিত।

আপনার সংগীতের হাতেখড়ি কার কাছে?
আমার সংগীত শিক্ষা শুরু হয় শ্রদ্ধেয়া শ্রীমতি সূচিত্রা মিত্রের শিষ্যা শ্রীমতি মৈত্রেয়ী মজুমদারের কাছে। তার কাছে রবীন্দ্র সংগীতের কঠোর অনুশীলন করতে হয়েছে। ধ্রুপদী সংগীতের চর্ম করতাম সেখানে। তারপর শিল্পী শ্রাবণী সেনের কাছে তালিম নিয়ে আরও এগিয়ে যাই সামনের দিকে।
সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের স্বামী মারা গেছেন
আপনি ইতোমধ্যে বহু মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেছেন। সবই কী কলকাতায়?
আমার জেলা মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরে একাধিকবার অনুষ্ঠান করেছি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে শুরু করে কলকাতার একাধিক সরকারি ও বেসরকারি মঞ্চে, দিল্লি, আগরতলা ও সম্প্রতি নাইজেরিয়ায় আমি ডাক পেয়েছিলাম গান শোনানোর জন্য।
গানের জগতে নিজের জায়গা করে নিতে আপনাকে বিশেষ কোনো বেগ পেতে হয়েছে কী না?
দেখুন, আমি মনে করি সংস্কৃতির সমস্ত অঙ্গনে সব বিষয়ে স্ট্রাগল আছে ও থাকবে। তবে আমি যেহেতু রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে খুব বিখ্যাত হব বা খুব বড় মঞ্চ পাব বা পেতেই হবে এই ইঁদুর দৌড়ে কখনোই যেতে চাইনি। তার ফলে আমাকে সেরকম খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তবে আমার কাছে কিছু আত্মীয়স্বজন যাদের কাছে সংগীত চর্চার বিষয়ে খুবই অসহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু আমার জেদ ও লড়াকু মনোভাব আমাকে গানের প্রতি মনোযোগী করেছে।

গান চর্চায় অটল থেকেছি। যতটা অসহযোগিতা এসেছে। আমি তত বেশি মনে মনে শক্তিশালী হয়েছি। আর যতটুকু ভালোবাসা পেয়েছি, মাথানত করে গ্রহণ করেছি। দিল্লিতে অমিতাভ মুখার্জির মতো সংগীতপ্রেমী ব্যক্তিত্ব আমাকে নিয়ে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে একক কনসার্টের ব্যবস্থা করেছেন। সেটা আমার কাছে এক বড় প্রাপ্তি। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে খুঁজে নিয়ে অশোক লস নাইজেরিয়ায় নিয়ে যান। সেখানে তিনি আমার ও শ্রাবণী সেনের একক কনসার্টের ব্যবস্থা করেন। এগুলো আমার জীবনে আশীর্বাদস্বরূপ।
সংগীতশিল্পী নুরুল আলম লাল আর নেই
পশ্চিমবঙ্গ তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রীর উদ্যোগে এক পক্ষজুড়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব পালিত হচ্ছে। আপনি কি ওখানে আমন্ত্রণ পেয়েছেন বা আগে কখনও পেয়েছেন?
না, আমি এখনও পর্যন্ত কোনো আমন্ত্রণ পাইনি। কোনোরকম যোগাযোগ করেননি কেউ।

আপনার গান নিয়ে ইতোমধ্যে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে?
হ্যাঁ, রেডিও মির্চির উদ্যোগে পাঁচটি সর্বাধিক মনোনীত জনপ্রিয় রবীন্দ্র সংগীতকে নির্বাচন করা হয়েছিল সেখানে আমার গান নির্বাচিত হয়েছে। সমালোচকরা ব্যপক প্রশংসা করেন।
সংগীতশিল্পী নাউমি বিয়ে করেছেন
সোশ্যাল মিডিয়া ও তার বাইরে আপনার অগণিত অনুরাগী। এত মানুষের ভালোবাসা এক বিরাট অর্জন। কেমন লাগে এসব?
প্রথমেই আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখি যারা আসলেই আমাকে শিল্পী শিরিন সোরাইয়ার জায়গায় বসিয়েছেন। আমার গানের প্রতি তাদের অসম্ভব ভালোলাগা দেখে আমি যারপরনাই উৎসাহ পেয়েছি। আমি সংগীত নিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছি তাদের জন্যে।
আপনার নিজের কোনো সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে?
না, আমি এখনই ভাবছি না এসব নিয়ে। তবে ভবিষ্যতে আমি নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব এমন ইচ্ছা আছে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজের কিছু কাজ রেখে যাব, এ ভাবনাটা আমার আছে।

বাংলাদেশে মুসলমান সমাজে বহুল গানের চর্চা হয়, সেভাবে আমাদের পশ্চিমবাংলায় দেখছি না কেন?
আমার যেটা মনে হয় যেহেতু এই সঙ্গীতের উপরে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করাটা বেশ কঠিন। তাই মুসলমান সমাজের ছেলে-মেয়েদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা এটাকে নিয়ে হয়তো সেভাবে ভাবতে পারেনি। স্থিতিশীল পেশার অভাবের কারণে তারা এই সংগীত চর্চার বিষয়ে উৎসাহিত হতে পারছেন না বলে আমি মনি করি।
রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ আর নেই
সংগীত জীবনে সবচেয়ে ভালো মুহূর্ত কোনটি?
আমি দুইটি মঞ্চের কথ্য অবশ্যই বলব। যখন বিদেশে আমি নাইজেরিয়ার মঞ্চে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করি আমি মনে মনে আনন্দিত ও খুবই গর্বিত হচ্ছিলাম। আর সম্প্রতি মুম্বইয়ের বেঙ্গল ক্লাবে শিবাজী পার্কের মঞ্চে আমার অগ্রজ যে শিল্পীরা ছিলেন ব্রততীদি, দেবশঙ্করদা, লোপামুদ্রাদি ও জয়দা তাঁদের সঙ্গে অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে পেরে আমার এক অসামান্য অভিজ্ঞতা ও আনন্দ হয়েছে। এজন্য এই মঞ্চগুলো আজীবন আমার স্মৃতিতে গর্বের সঙ্গে ধরে রাখব।
সৌজন্যে: পুবের কলম