images

অর্থনীতি

ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের ‘নীরব বিপ্লব’

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৪১ এএম

সারা বিশ্বেই দিন দিন বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশও। একটা সময় ব্যাংকের সব ধরনের লেনদেন হতো চেকের মাধ্যমে। এসব হিসাব মেন্টেইন করতে হতো রেজিস্টারের মাধ্যমে। আগে এক ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংক গ্রহণ করতো না। পরবর্তী সময়ে অন্য ব্যাংকের চেক গ্রহণ পদ্ধতি চালু হলেও সেই টাকা জমা হতে বেশ কয়েক দিন লেগে যেত। আবার টাকা পাঠানোর জন্য কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসাও ছিল জমজমাট। কেনাকাটা ও লেনদেনের পুরোটাই হতো নগদ টাকায়। সময়ের সঙ্গে বদলে যেতে থাকে লেনদেনের ধরন। এখন ব্যাংক লেনদেনের বড় একটা অংশই হয় ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। বর্তমানে এক মাসেই এই লেনদেন ছাড়িয়েছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অ্যাপস ব্যবহার করে চলতি বছরের জুন মাসে লেনদেন হয়েছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। আর পরের জুলাই মাসে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে ইন্টারনেট ব্যবহার করে লেনদেন বেড়েছে ৮ হাজার ৫৩৫ কোটি।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের কারণে দেশের ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের বিস্তার ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়ে গেছে। গ্রাহকদের একটা অংশ সরাসরি ব্যাংকে যাওয়ার পরিবর্তে অনলাইন মাধ্যমকে বেছে নেয়। অনেক গ্রাহক সরাসরি ব্যাংকিং বা কেনাকাটা বাদ দিয়ে ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা অলাইনে কেনাকাটা করছেন। এ কারণে লেনদেন বেড়ে যেতে পারে।

দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে। লেনদেনের প্রায় অর্ধেকই করেন ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকেরা। এরপর রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের অ্যাপস নেক্সাস পে, সিটি ব্যাংকের সিটি টাচ, ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা, ইস্টার্ন ব্যাংকের স্কাই ব্যাংকিং। এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমটিবি স্মার্ট, ঢাকা ব্যাংকের গো অ্যাপসসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকের অ্যাপসে ভালো গ্রাহক রয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে দেশে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহারকারী গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৩ জন। আর পরের মাস জুলাইয়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৫৯৪ জন। সেই হিসাবে জুলাইয়ে গ্রাহক বেড়েছে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩১ জন।

Banking3
ব্যাংকের লাইন এড়াতে ইন্টারনেটে লেনদেন করেন অনেকেই। ছবি: সংগৃহীত

এক দশক আগেও কেনাকাটা ও লেনদেনের পুরোটাই হতো নগদ টাকায়। পরিষেবা বিল পরিশোধের জন্যও ব্যাংকগুলোতে লাইন লেগে থাকত। মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতেও প্রতিটি বাজার ও মহল্লায় ছিল একাধিক দোকান। কিন্তু ব্যাংকিং লেনদেনে এখন যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি। বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অ্যাপসনির্ভর ব্যাংকিং সেবা। বর্তমানে দেশের প্রায় ৮০ লাখ গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অ্যাপস দিয়ে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছেন। ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অ্যাপসগুলোর মাধ্যমে হিসাবের স্থিতি জানা, যেকোনো ব্যাংকে টাকা স্থানান্তর, পরিষেবা বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, টিকিট কেনা, কার্ডের বিল পরিশোধ, মাসিক সঞ্চয় হিসাবে টাকা জমাসহ নানা সুবিধা পাওয়া যায়।

তথ্য মতে, জুনে এসব গ্রাহক লেনদেন করেছে ১ কোটি ৮৩ লাখ ৫ হাজার ২৪টি। আর জুলাইয়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭৮২ টিতে। অর্থাৎ ১ মাসের ব্যবধানে গ্রাহক ও লেদেন দুটোই বেড়েছে।

আরও পড়ুন

প্রান্তিক জনপদে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ‘নীরব বিপ্লব’

বৈষম্য দূর করতে ‘বৈষম্যমূলক’ নীতিমালা

এদিকে ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা প্রযুক্তির মাধ্যমে লেনদেনের যেমন সুবিধা রয়েছে তেমনি সচেতন থাকারও বিষয় রয়েছে। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে জনগণের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ই-কমার্স, অনলাইন ব্যবসা, অফলাইন বিনিয়োগ বা ক্রাউডফান্ডিংয়ের নামে কিছু প্রতিষ্ঠান 'দ্রুত লাভের নিশ্চয়তা' দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার জালে ফেলছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সতর্কবার্তা জারি করে জনগণকে এসব প্রলোভনে না পড়ার আহ্বান জানিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং অফলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে 'অস্বাভাবিক রিটার্ন'-এ ধরনের প্রস্তাব দিয়ে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করছে। পরে তারা গ্রাহকের 'ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ওপিটি' সংগ্রহ করে হজের টাকা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অর্থ কিংবা সরকারি ভাতার অর্থ ফেরতের আশ্বাস দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করছে।

Banking2
ইন্টারনেটে ঘরে বসে সহজেই করা যায় সব ধরনের লেনদেন। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ব্যাংক জনসাধারণকে সচেতন করতে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে, যেমন-অস্বাভাবিক লাভের প্রলোভনে পা দেবেন না। অতিরিক্ত মুনাফার আশ্বাস সন্দেহজনক। লেনদেনের আগে প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদন ও বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করুন। ওটিপি পাসওয়ার্ড কিংবা ব্যক্তিগত তথ্য কাউকেই শেয়ার করবেন না, এমনকি পরিচিত কেউ অনুরোধ করলেও নয়। সরকারি ভাতা বা সহায়তার নামে কোনো লোভনীয় প্রস্তাব গ্রহণ করবেন না। সেগুলোর সত্যতা যাচাই ছাড়া সিদ্ধান্ত নেবেন না।

আরও পড়ুন

ব্যাংক খাতে ‘রক্ষকরাই ভক্ষক’, দৃশ্যমান হচ্ছে আমলনামা

ধরাছোঁয়ার বাইরে ‘লুটেরাদের ক্যাশিয়ার’ আব্দুর রউফ তালুকদার

এ বিষয়ে সাইবার বিশেষজ্ঞ কম্পিউটার নেটওয়ার্ক প্রকৌশলী, সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা সৈয়দ জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগে যেমন ব্যাংকে গিয়ে চেকের মাধ্যমে লেনদেন করা একটা জটিল বিষয় ছিল, এখন সেটা ঘরে বসেই করা যাচ্ছে। ডিজিটাল লেনদেন আমাদের জন্য কখনোই ক্ষতিকারক না। তবে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। ইন্টারনেট ব্যাংকিয়ের জন্য ব্যাংকগুলো যে সফটওয়্যার তৈরি করে তা সিকিউরিটি কনসার্ন দিয়েই তৈরি করে। এজন্য ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে যেমন পাসওয়ার্ড ওটিপি কাউকে না দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তেমনি সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’

টিএই/জেবি