*মূল্যায়নে কমছে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার গুরুত্ব
*২০ বছর কর্মকালেই হতে পারবেন এমডি
*জুনিয়র-সিনিয়র বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির শঙ্কা
*উল্লেখযোগ্য অর্জনকে বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ
বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে নতুন নীতিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে ‘রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালা-২০২৫’ নামে এই খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। নতুন এই নীতিমালায় অনেক কিছুই নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডিএমডি পদে দুই বছরের অভিজ্ঞতাসহ ৯ম গ্রেড হতে ন্যূনতম ২০ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত এই নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এই নীতিমালার কারণে নতুন করে বৈষম্য তৈরি হতে পারে। বঞ্চিত হতে পারেন মাঠ পর্যায়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা। স্বল্প অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও জুনিয়র কর্মকর্মতারা উচ্চ পর্যায়ে যেতে পারে। যার প্রভাবে পিছিয়ে পড়তে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
বিজ্ঞাপন
অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালা ২০২৩-কে যুগোপযোগী করা সমীচীন ও প্রয়োজনে নতুন নীতিমালা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। নতুন এই নীতিমালা রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের জন্য প্রযোজ্য হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পদায়ন করা হবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হবে।
>> আরও পড়তে পারেন
যোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হতে হবে। তবে অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ফাইন্যান্স, ব্যাংকিং, ব্যবস্থাপনা অথবা ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত শিক্ষায় যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে; শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি থাকতে পারবে না। গ্রেডিং পদ্ধতিতে প্রকাশিত ফলাফলের ক্ষেত্রে এসএসসি বা সমমান ও এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষার ক্ষেত্রে জিপিএ ৩ এর কম এবং অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত সিজিপিএ এর ক্ষেত্রে ৪ পয়েন্ট স্কেলে ২.৫০ এর কম ও ৫.০০ পয়েন্ট স্কেলে ৩.০০ এর কম হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বিদেশ থেকে ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রকাশিত ফলাফল (শ্রেণি বিভাগ বা জিপিএ) যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত ও সত্যায়িত হতে হবে।
এছাড়াও প্রস্তাবিত পদের অব্যবহিত পূর্ববর্তী পদগুলোতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর উপর অর্পিত কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে সততা ও সুনাম থাকতে হবে এবং প্রার্থীদের অবশ্যই রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে ডিএমডি পদে দুই বছরের অভিজ্ঞতাসহ ৯ম গ্রেড হতে ন্যূনতম ২০ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এমডি পদোন্নতিতে ২০ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতার উল্লেখ রয়েছে। এই কর্ম অভিজ্ঞতার সুনির্দিষ্ট কোনো বিবরণ নেই যেটি দক্ষ নির্বাহী নিয়োগের যথার্থতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। সুতারাং, এমডি নিয়োগে ব্যাংকিং বিষয়ে পেশাগত জ্ঞান অর্জন এর পাশাপাশি ২৫ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। এই কর্মকালে মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা তথা শাখা, কর্পোরেট শাখা, জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয় এবং স্থানীয় কার্যালয়ের মত কর্পোরেট স্টাব্লিসমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফাইন্যান্স, জেনারেল অ্যাডভান্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট, ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ডিভিশনে কাজের অভিজ্ঞতা ও ব্যাংকের পক্ষে উল্লেখযোগ্য অর্জন কে বিবেচনায় নিয়ে নীতিমালা করা জরুরি।
>> আরও পড়তে পারেন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত নীতিমালায় ডিএমডি হতে এমডি পদোন্নতি নীতিমালায় ডিএমডি হিসেবে দুই বছরের কর্মকাল নতুন করে বৈষম্যের সৃষ্টি করবে। কারণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদোন্নতি নীতিমালার দরুন কোনো ব্যাংকের নির্বাহীগণ যথাসময়ে পদোন্নতি পেয়েছে বিপরীতে কোনো ব্যাংকের নির্বাহীগণ পদোন্নতিতে অনেক পিছিয় রয়েছে। এতে জুনিয়র ও সিনিয়রের ভারসাম্যে ব্যাঘাত হয়ে যথার্থ কর্মপরিবেশ বিশৃঙ্খলা হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে ডিএমডি হতে এমডি পদোন্নতিতে ডিএমডি পদে দুই বছরের চাকুরিকালের পরিবর্তে মোট কর্মকাল গণনা করলে দীর্ঘদিনের এই বৈষম্য দূরীভূতকল্পে যোগ্য ব্যাংকিং নেতৃত্ব গড়ে উঠে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সুচারুরূপে পরিচালনা করা সহজ হবে। সেইসাথে বৈষম্যহীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতি বিশ্লেষক ও গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে শুধুমাত্র নীতিমালা প্রণয়ন করলে যথেষ্ট হবে না, এর কার্যকর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। অবশ্যই দক্ষতা ও যোগ্যাতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার পরিবর্তনের সাথে ব্যাংকসমূহের পরিচালনা পর্ষদেও বেশ পরিবর্তন আনা হয়েছে। তারপরও সুশাসনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকখাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একটি স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, এই বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাশোনা করে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীনে আছে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নিয়োগ পদোন্নতি ও নীতিমালার বিষয়গুলো পুরোপুরি দেখভাল করে। কর্মকর্তারা চাইলে তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলো সমাধান করতে পারে।
টিএই/এএস

