শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ব্যাংক খাতে ‘রক্ষকরাই ভক্ষক’, দৃশ্যমান হচ্ছে আমলনামা

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১৫ আগস্ট ২০২৫, ০৬:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

bank
সাবেক তিন গভর্নর ও ছয় ডেপুটি গভর্নর। ছবি: সংগৃহীত

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতির যারা মূল পাহারাদার ছিলেন তারাই লুটপাটের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। অর্থনীতিকে যারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন তাদের অন্যতম বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ফজলে কবির ও ড. আতিউর রহমান। যে হাত দিয়ে তারা টাকায় স্বাক্ষর করেছিলেন একই হাত দিয়ে স্বাক্ষর করেছিলেন লুটপাটের চুক্তিতেও। অবশেষে শেষ রক্ষা হচ্ছে না তাদেরও। দেরিতে হলেও দৃশ্যমান হচ্ছে তাদের আমলনামা। তাদের আর্থিক খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ও ছয় ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাবসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য তলব করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধে দেশের সব তফসিলি ব্যাংকে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ফরম, লেনদেনের বিস্তারিত বিবরণ, কেওয়াইসি ফরমসহ সব তথ্য আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। যদি কোনো হিসাব বন্ধ হয়ে থাকে, সেটির তথ্যও জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


যাদের হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। আওয়ামী লীগ সরকার বিদায়ের পর ড. আতিউর রহমান দেশত্যাগ করেন। আব্দুর রউফ তালুকদার পলাতক অবস্থায় গত বছরের ৭ আগস্ট ই-মেইলে পদত্যাগ করেন। ব্যাংক হিসাব তলবের তালিকায় থাকা অন্যরা সবাই সাবেক ডেপুটি গভর্নর। তারা হলেন এস কে সুর চৌধুরী, মো. মাসুদ বিশ্বাস, আবু হেনা মো. রাজী হাসান, এসএম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান ও আবু ফরাহ মো. নাছের। এদের মধ্যে এস কে সুর চৌধুরী বর্তমানে দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি। মো. মাসুদ বিশ্বাস বিএফআইইউর প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। আবু হেনা মো. রাজী হাসান দীর্ঘদিন বিএফআইইউর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সরকার পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আর্থিক কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবেই ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Bank3
সব লুটপাটের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

সাবেক তিন গভর্নর এবং চার ডেপুটি গভর্নরের পাশাপাশি তাদের স্ত্রী, সন্তান এবং সন্তানদের স্বামী বা স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বিএফআইইউ। তলবের আওতায় আনা হয়েছে সংস্থাটির সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান ও মো. মাসুদ বিশ্বাস এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের হিসাবও।

অভিযোগ রয়েছে, নানা অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে ব্যাংক খাত থেকে নামে-বেনামে বিভিন্ন গ্রুপ প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ করে দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার অতি আস্থাভাজন হওয়ায় যখন-তখন যোগাযোগ করতে আব্দুর রউফ তালুকদারের কোনো পর্দা ছিল না। ‘ব্যাংক খেকো’ এস আলমকে হাসিনার ‘ক্যাশিয়ার’ বলা হলেও লুটেরা গোষ্ঠীর ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন আবদুর রউফ তালুকদার। পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ না পেলেও দুই বছরে দেশের ব্যাংক খাতকে তিনি ক্ষত-বিক্ষত করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ ক্ষত তৈরি হয়েছে, এমন ঘটনা অতীতে আর কখনো ঘটেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তিনি সব অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ তিনিই একমাত্র গভর্নর, যিনি সরকার পরিবর্তনের পর পালিয়ে যান এবং পলাতক থেকেই পদত্যাগ করেন।

আরও পড়ুন

ধরাছোঁয়ার বাইরে ‘লুটেরাদের ক্যাশিয়ার’ আব্দুর রউফ তালুকদার

‘লুটপাট’ কমলেও ব্যাংক মালিকদের ‘পেটেই’ ঋণের পৌনে দুই লাখ কোটি

লুটেরাদের কাছে ‘গরিবের বউ’ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক!

গভর্নরদের মধ্যে ‘আজ্ঞাবহ’ গভর্নর হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১তম গভর্নর ফজলে কবির। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও প্রভাবশালীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে কাউকে অখুশি করতেন না। গভর্নরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশের ইতিহাসে আইন পরিবর্তন করে দ্বিতীয় মেয়াদে নিযুক্ত করা হয় তাকে। এর আগে অর্থ সচিব ও রেলপথ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফজলে কবির গভর্নরের দায়িত্বে থাকাকালে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তেই আপত্তি জানাননি। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা, ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধা, নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, ব্যাংক পরিচালকদের জন্য আইন পরিবর্তন, সুদহার ৯ শতাংশ করা কোনো ক্ষেত্রেই প্রশ্ন তোলেননি তিনি। অর্থাৎ তিনি যা করেছেন সবই ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ছিল প্রভাবশালীদের চাপও। এসব কারণে বেশ সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে।

ব্যাংক খাতে বিপর্যয়ের অন্যতম কারিগর  ড. আতিউর রহমান। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলেন, পরিদর্শনব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেন। ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাটের সুযোগ করে দেন তিনি। তার সময়ে নীতিমালার শিথিলতায় শুরু হয় জালিয়াতি। ওই সময়ে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ক্রিসেন্ট, অ্যাননটেক্সের জালিয়াতি প্রকাশিত হয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দেওয়া নয় ব্যাংকের কোনোটিই দাঁড়াতে পারেনি। অপরিকল্পিত ও অদক্ষ আইটি ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণের কারণে রিজার্ভ চুরির সুযোগ তৈরি হয়। অদক্ষতা, ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বকীয়তাকে খর্ব করা, ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ায় খাতটি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। তিনিই মূলত ব্যাংক খাত ধ্বংসের মূলহোতা। তার সময়েই ব্যাংকের সব সূচকের অবনতি ঘটে।

Bank2
হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের চিত্র সামনে আসছে। ছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী সরকারের তিন মেয়াদের পূর্ণ সময়ে দায়িত্ব পালনকারী এই তিন গভর্নরদের যারা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন তারা হলেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী, মো. মাসুদ বিশ্বাস, আবু হেনা মো. রাজী হাসান, এসএম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান ও আবু ফরাহ মো. নাছের। এদের মধ্যে শুধু এস কে সুর চৌধুরী ও মাসুদ বিশ্বাস বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন।

২০১০-২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ছিল দেশের ইতিহাসে প্রথম ও সবচেয়ে বড় অর্থ কেলেঙ্কারি। এরপর রিজার্ভ চুরি ও বিভিন্ন সময় বেসিক, জনতা, ফারমার্স এবং ইসলামী ব্যাংক কেলেঙ্কারিসহ অন্তত ২৫টি অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ৯২-৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লোপাট হয়েছে। এসব কেলেঙ্কারিতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও গ্রুপের নাম সামনে এলেও আড়ালে ছিলেন মাস্টারমাইন্ডরা। ব্যাংকখাতে মহা-হরিলুটে নেতৃত্ব দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। যাদের কাছে জিম্মি ছিল ব্যাংকপাড়া। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, মূলত শর্ষের মধ্যে ভূত হয়ে ছিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অর্থ পাচার ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা এই সংস্থাটির সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস নিজেই অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন।

আরও পড়ুন

‘থার্ড ক্লাস’ এমডিতে ফার্স্ট সিকিউরিটির সর্বনাশ!

‘কোমর ভাঙা’ এক্সিম ব্যাংকের দাঁড়িয়ে থাকার ভান!

রাঘববোয়াল-চুনোপুটি মিলেমিশে লুটেছে ইউনিয়ন ব্যাংক

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে যাতে কোনো অনিয়ম না হয় এজন্য তাদের বিচারের মধ্যদিয়ে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যাদের মৌলিক দায়িত্ব ব্যাংকিং খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা। বাংলাদেশ ব্যাংকে যারা শীর্ষ পদে ছিলেন তাদের অনেকেই ব্যাংকিং খাতের লুটপাট থেকে শুরু করে ধসে পড়ার পেছনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছেন- এতে সন্দেহের অবকাশ নাই। এদের সাথে যোগসাজস এবং তাদের অনুকম্পা ছাড়া লুটপাট ও অর্থপাচার কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। কাজেই অপরাধ প্রমাণিত হলে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।’

গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একজন গভর্নর হলেন ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক। লুটপাট বা দুর্নীতি হলে তিনি ন্যূনতম নৈতিক ও প্রশাসনিক দায় এড়াতে পারেন না। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব অনিয়ম রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে হয়। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে অপরাধ প্রবণতা চলতেই থাকে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সকল অনিয়মের বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর