- অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে খেলাপিদের বড় সুবিধা
- হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগে ছিল না কোনো পর্দা
- লুটপাটের তথ্য ঢাকতে সাংবাদিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা
- দিয়াবাড়িতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে তালুকদারের লাল বাড়ি
দেশের অর্থনীতিকে যারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন তাদের অন্যতম বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। নানা অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে ব্যাংক খাত থেকে নামে-বেনামে বিভিন্ন গ্রুপকে লক্ষ কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ করে দেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার অতি আস্থাভাজন হওয়ায় যখন-তখন যোগাযোগ করতে আব্দুর রউফ তালুকদারের কোনো পর্দা ছিল না। ব্যাংক খেকো এস আলমকে হাসিনার ‘ক্যাশিয়ার’ বলা হলেও লুটেরা গোষ্ঠীর ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন আবদুর রউফ তালুকদার।
বিজ্ঞাপন
পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ না পেলেও দুই বছরে দেশের ব্যাংক খাতকে তিনি ক্ষত-বিক্ষত করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ ক্ষত তৈরি হয়েছে, এমন ঘটনা অতীতে আর কখনো ঘটেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তিনি সব অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ তিনিই একমাত্র গভর্নর, যিনি সরকার পরিবর্তনের পর পালিয়ে যান এবং পলাতক থেকেই পদত্যাগ করেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ব্যাংকে আসেননি তৎকালীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। পরে ৯ আগস্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন তিনি। কিন্তু যিনি দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের অন্যতম কারিগর হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তার বিরেুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হওয়ারও খবর পাওয়া যায়নি। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে তার একটি পাঁচতলা বাড়ি সন্ধান পাওয়া গেছে। দিয়াবাড়ির ১৬নং সেক্টরের সি ব্লকের ২নং রোডে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে তার দৃষ্টিনন্দন লাল বাড়ি। সেই বাড়িতে অবস্থান না করলেও আবদুর রউফ তালুকদার এখনো দেশেই আছেন বলে জানা গেছে।
গভর্নর নিযুক্তির আগে অর্থ সচিব ছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার। বিভিন্ন সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করলেও চাকরিজীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি কাজ করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন থাকার সুবাধে ফ্যাসিবাদের সহযোগী ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক ছিল আব্দুর রউফ তালুকদারের। তাই তাকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে জোর তদবির করা হয়েছিল। মূলত ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত সুবিধা নিতেই তাকে গভর্নর হিসেবে চেয়েছিলেন। আর গভর্নর হওয়ার পর তিনি অকৃতজ্ঞ হননি। নিয়মনীতি সব বিসর্জন দিয়ে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়েছেন।
গভর্নর হয়েই খেলাপিদের বড় ছাড়
আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় ২০২২ সালের ১৮ জুলাই ঋণখেলাপিদের বড় ছাড় দিয়ে একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করেন। সার্কুলারে আড়াই থেকে সাড়ে চার শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দিয়েছিলেন। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। আবার এসব ঋণ পরিশোধ করার সময় দিয়েছিলেন পাঁচ থেকে আট বছরের মধ্যে। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ঋণ জালিয়াতির ঘটনা আব্দুর রউফ তালুকদারের নাম শোনা যায়। বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংক মালিক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ব্যবসায়ী এবং ব্যাংক মালিকদের নিয়ন্ত্রণ না করে উল্টো তাদের অনিয়ম-জালিয়াতিগুলোকে ঢেকে রাখার কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
পুনঃতফসিলের পরও রেকর্ড খেলাপি ঋণ
বারবার পুনঃতফসিল করেও ঠেকানো যায়নি খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষেও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালের মার্চে এসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আবার জুন মাসে খেলাপি ঋণ ছাড়ায় ২ লাখ ১১ হাজার কোটি। আর পুনঃতফসিল, অবলোপন, বেনামি ঋণসহ ঝুঁকিতে রয়েছে এমন ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা।
তলানিতে রিজার্ভ
দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে তলানিতে আসে আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে। তিনি যোগদানের সময় গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। এরপর কমতে কমতে তা নেমে আসে ১৮ বিলিয়নের ঘরে। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য বা নিট রিজার্ভ নামে ১৪ বিলিয়ন পর্যন্ত।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ব্যাংকে আসেননি তৎকালীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। পরে ৯ আগস্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন তিনি। কিন্তু যিনি দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের অন্যতম কারিগর হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
ব্যাংক পরিদর্শনে হস্তক্ষেপ
আগে কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলেই ওই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় পরিদর্শন করা হতো। অভিযোগের বিষয় তদন্ত হতো। আব্দুর রউফ তালুকদার আসার পর এগুলো খুব একটা করা হয়নি। ব্যাংক পরিদর্শনকালেও কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেন না। সেখানেও হস্তক্ষেপ করতেন তিনি। আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন কমে অর্ধেকে নামে।
এস আলমসহ বিভিন্ন গ্রুপকে বিশেষ সুবিধা
আব্দুর রউফ তালুকদার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হন এস আলমসহ বিভিন্ন গ্রুপকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদানে তিনি সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এছাড়া অনিয়ম আর ঋণ জালিয়াতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়া এস আলমের ব্যাংকগুলোকে নগদ সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি এই গ্রুপের সাতটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলতি হিসাবে ঋণাত্মক রেখেও বিনা বাধায় লেনদেন করত।
অনিয়ম ঢাকতে সাংবাদিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা
ব্যাংক খাতের অনিয়ম ঢাকতে সাংবাদিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে হঠাৎই বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা দেন গভর্নর। তখন সাংবাদিকদের ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশের অস্থায়ী পাস ইস্যু বন্ধ রাখা হয়। তবে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার আবার স্বাভাবিক হয়।
‘ডি’ গ্রেড গভর্নর
মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর গভর্নরদের রেটিং করে গ্লোবাল ফাইন্যান্স। যার সর্বনিম্ন মান ‘ডি’, অর্থাৎ এর নিচে আর দেওয়ার অপশন ছিল না। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের র্যাংকিংয়ে গভর্নর হিসেবে ‘ডি’ গ্রেড পান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। যেখানে ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের গভর্নরও থাকে বাংলাদেশের ওপর।
আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় ২০২২ সালের ১৮ জুলাই ঋণখেলাপিদের বড় ছাড় দিয়ে একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করেন। সার্কুলারে আড়াই থেকে সাড়ে চার শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দিয়েছিলেন। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। আবার এসব ঋণ পরিশোধ করার সময় দিয়েছিলেন পাঁচ থেকে আট বছরের মধ্যে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি নিয়োগকৃত কাউকে বাংলাদেশ ব্যাংক জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে পারে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ব্যাংলাদেশ ব্যাংক সাবেক কোনো কর্মকর্তাকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে পারে না। সেই দায়িত্ব সরকারের। গভর্নর ডেপুটি গভর্নর সরকার নিয়োগ করে। সরকার মনোনীত ব্যক্তি যদি সরকারের দৃষ্টিতে তার দায়িত্ব পালনে অবহেলার প্রমাণ পায় সেটার বিষয়ে সরকারই ব্যাখ্যা চাইতে পারে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসৎ আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। একদিকে পক্ষপাত করে বিভিন্ন গ্রুপ প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যারা অসদাচরণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে তো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি যেটা দেখে অন্যরা উৎসাহিত হয়েছে, যা একটা ছোঁয়াচে রোগে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একজন গভর্নর হলেন ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক। লুটপাট বা দুর্নীতি হলে তিনি ন্যূনতম নৈতিক ও প্রশাসনিক দায় এড়াতে পারেন না। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব অনিয়ম রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে হয়। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে অপরাধ প্রবণতা চলতেই থাকে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সকল অনিয়মের বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
টিএই/জেবি

