images

অর্থনীতি

৬ মাস পর ফের বাড়ল হাতে নগদ টাকা রাখার প্রবণতা

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

০৭ জুন ২০২৫, ০৫:২৬ পিএম

  • হাতে নগদ টাকা বেড়ে প্রায় তিন লাখ কোটি
  • এক মাসে বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি
  • এই প্রবণতা ঠেকাতে ব্যাংকে আস্থা ফেরানোর তাগিদ

আবারও ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজের হাতে রাখার প্রবণতা দেখা গেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মানুষের হাতে নগদ টাকার স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। যা পরবর্তী মার্চ মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসেই মানুষের নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। যদিও গত মার্চ মাস পবিত্র রামজান মাস ও ঈদের মাস ছিল। এই সময়ে মানুষ একটু বেশি বেশি খরচ করে থাকে। তারপরও ২৫ হাজার কোটির অংকটা একটু অস্বাভাবিক হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময়ে নজিরবিহীন লুটপাট হয় ব্যাংক খাতে। এতে ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থার সংকট চরম আকার ধারণ করে। আতঙ্কিত হয়ে মানুষ ব্যাংকের টাকা তুলে বাসায় রাখতেন। যার ফলে ব্যাংকগুলোতে দেখা দেয় চরম তারল্য সংকট। এমন অবস্থায় ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। কিন্তু এতেও কাজে আসেনি। প্রতি মাসেই বাড়ছিল মানুষের হাতে নগদ টাকা তথা ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ। গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত মানুষের হাতে নগদ টাকা বা ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল।

আরও পড়ুন

বিপুল পুনঃতফসিলেও বেসামাল খেলাপি ঋণ

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় শরিয়াহ ব্যাংকগুলো, ফিরছে আস্থা

তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা পুনরায় বাড়তে থাকে। পরের মাস সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করে মানুষের হাতে রাখা টাকা। যেটার ধারাবাহিকতা চলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। পরের মাস মার্চে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ আবার বেড়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে মানুষ টাকা বেশি তুলে নিয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছিল ২৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা।

Taka2
টাকা তুলতে ব্যাংকে গ্রাহকদের ভিড়। ছবি: সংগৃহীত

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের আগস্টে মানুষের হাতে বা ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি ৪ লাখ টাকা। আর পরের মাস সেপ্টেম্বরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪ লাখ, পরের মাস অক্টোবরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি ৭ লাখ, পরের মাস নভেম্বরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৫৬ কোটি ৭ লাখ, পরের মাস ডিসেম্বরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭১ কোটি ৫ লাখ, চলতি বছরের জানুয়ারিতে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৩০ কোটি ৯ লাখ এবং ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৬ লাখ টাকা। আর চলতি বছরের মার্চে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি ৬ লাখ টাকা।

তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধারাবাহিক কমছিল ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ। কিন্তু নভেম্বর থেকে আবার বাড়তে শুরু করে। যেটা গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

আরও পড়ুন

ব্যাংকে হাহাকার, ফুটপাতে এত নতুন নোট এলো কীভাবে?

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের ৩৩ শতাংশই খেলাপি

প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। পরের মাস নভেম্বরে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, ডিসেম্বরে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি, জানুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৯৫ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি, মার্চে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি, এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি, মে মাসে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি, জুনে ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি, জুলাইয়ে ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৩০ কোটি ও আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি ৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ দশ মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে ৪৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের খরচ বেশি হয়। এজন্য বাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখে। তারপর ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে কিছু ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থায়ও ঘাটতি এসেছিল। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছিল। এখন আস্থা ফেরায় মানুষ আবার ব্যাংকে টাকা রাখছে।

Taka3
ব্যাংকে আস্থা ফেরানোর তাগিদ অর্থনীতিবিদদের। ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে, মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি বাজারে মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার স্থিতি (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬০২ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর পরের মাস অর্থাৎ চলতি বছরের মার্চে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ কোটি ৬ লাখ টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে ২৮ হাজার ১৩০ কোটি ৭ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন

নতুন রেজুলেশন: কী প্রভাব ফেলবে ব্যাংক খাতে?

ডলারের বাজারে অস্থিরতার পাঁয়তারা!

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের সামগ্রিক আর্থিক শৃঙ্খলা, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না হলে ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা পুরোপুরি ফিরবে না। আর সে পর্যন্ত মানুষের হাতে নগদ টাকা বাড়ার এই প্রবণতা থামবে না। এজন্য যেকোনোভাবে ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে।

এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলে, অতীতে বিভিন্ন কারণে মানুষের ব্যাংক খাতের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল। এখন মানুষের ওপর আবার সেই আস্থা তৈরি হচ্ছে। তবে আমার মনে হয় গত মার্চে রোজা ও ঈদের কারণে মানুষের টাকা তোলার প্রবণতা কিছুটা বেশি ছিল। তবে ব্যাংকগুলোকে ইনোভেটিব কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। যাতে করে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে বেশি বেশি উদ্বুদ্ধ হয়। ব্যাংকে যত টাকা ফিরবে দেশের অর্থনীতি তত বেশি গতিশীল হবে।

টিএই/জেবি