দেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মাধ্যমে। তখনকার কিছু সৎ মানুষের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংক খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং দ্রুতই প্রসার পেতে থাকে। দেশের মানুষের ধর্মের প্রতি পরম অনুরাগ খুব দ্রুতই ইসলামী ব্যাংককে শীর্ষস্থানে নিয়ে যায়। শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিই নয়, যাত্রা শুরু হয় আরও বেশ কিছু ইসলামি ব্যাংকের। তবে শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর এই প্রবৃদ্ধির ওপর লোলুপ চোখ পড়ে একটি চক্রের।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওই চক্রটি লুটপাটের অভয়ারণ্য হিসেবে বেছে নেয় ইসলামি ব্যাংকগুলোকে। তৎকালীন সরকারে প্রত্যক্ষ মদদে লুটেরা গোষ্ঠীর লুটপাটে দুর্বল হয়ে পড়ে দেশের অধিকাংশ শরিয়াহ ব্যাংক। এরপরও নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এসব ব্যাংক। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বেশ কিছু মন্তব্য মাঝে-মধ্যে হতাশ করছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকার ও গ্রাহকদের।
দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের অনিয়ম শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো চেপে রাখা হলেও সরকার পতনের পর এসব অনিয়মের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকে। আস্থার সংকট তৈরি হয় পুরো ব্যাংক খাতে। বিশেষ করে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা কমে যাওয়ায় ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত কমতে থাকে। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে এক হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। তবে বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আবার এক মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ ডিসেম্বরে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের (পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক, প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং শাখা, ইসলামি উইন্ডো) আমানত বেড়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশ সর্বশেষ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মোট আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৫ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, যা তার আগের মাস নভেম্বরে ছিল চার লাখ ৩৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। আমানত বেড়েছে ৪০৭ কোটি টাকা। তবে এক বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের আমানত ছিল চার লাখ ২২ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ১০ শতাংশ।
বিজ্ঞাপন
তথ্য বলছে, ২০২৪ বছরের ডিসেম্বরে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৮৫ হাজার ২৫০ কোটি টাকা, যেখানে তার আগের মাস নভেম্বরে ছিল তিন লাখ ৮৭ হাজার ৩২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে আমানত কমেছে এক হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। তবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এসব ব্যাংকের আমানত ছিল তিন লাখ ৮৪ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে এক লাখ এক হাজার ১১৪ কোটি টাকা। যদিও এক বছরের ব্যবধানে প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং শাখাগুলোতে আমানত বেড়েছে ৪০ দশমিক ১৫ শতাংশ, ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডোগুলোতে বেড়েছে ২০ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা সবাই জানি ইসলামি ব্যাংকগুলোতে কীভাবে লুটপাট চালানো হয়েছে। তবে ইসলামি ব্যাংকগুলো আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি। এই সংকটাবস্থায়ও আমরা নতুন আমানত সংগ্রহ করছি। ইসলামি ব্যাংকগুলোতে একটা প্যানিক তৈরি হয়েছিল। যার কারণে অনেক গ্রাহক একসঙ্গে টাকা তুলতে এসেছিল। এখন এক দিনে যদি সব মানুষ টাকা তুলতে আসে তবে তো কোনো ব্যাংকই তা দিতে পারবে না। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। আমরা নতুন ডিপোজিটর পাচ্ছি। আমরাও আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি খুব শিগগিরই সংকট কেটে যাবে।’
এদিকে এক বছরের ব্যবধানে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বিনিয়োগ বেড়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই খাতের বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ২৬ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। যেখানে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল চার লাখ ৭৭ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৮ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। তবে এই সময়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ বেড়েছে ৯ দশমিক ২২ শতাংশ, প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং শাখাগুলোতে বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ আর উইন্ডোগুলোতে বেড়েছে ৬ দশমিক ২১ শতাংশ।
আরও পড়ুন-
এছাড়াও এক বছরে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রফতানি আয় বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলোতে রফতানি আয় বেড়েছে ৩৩ দশমিক ১৩ শতাংশ, প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং শাখাগুলোতে বেড়েছে ৫৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমদানি বিল পরিশোধ এক বছরে বেড়েছে ২৯ শতাংশ। এরমধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলোতে বেড়েছে ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ, প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং শাখাগুলোতে বেড়েছে ১৭৯ শতাংশ।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই রেমিট্যান্স পাঠাতে আস্থা রেখেছেন প্রবাসীরা। ২০২৩ সালের শেষের দিকে দেশে প্রবাসী আয়ের মন্দা অবস্থা চলে। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই প্রবাসী আয়ের জোয়ার দেখা যায়। এক মাসে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রবাসী আয় বেড়েছে ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৪ সালের নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে ইসলামি ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে ১৩ শতাংশ রেমিট্যান্স বেশি পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। রেমিট্যান্স আহরণে এখনও শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর প্রায় সময় দুর্বল হয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলো নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করে যাচ্ছেন, যা এসব ব্যাংককে আরও আস্থাহীন করছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই গভর্নর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘জালিয়াতি ও লুটপাটে দেশের ১০ ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে।’ তার এই মন্তব্য যে আগুনে পানির বদলে ঘি ঢালার মতো অবস্থা দাঁড়ায়। এরপরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসব ব্যাংক নিয়ে কথা চালিয়ে যান তিনি।

সবশেষ গত ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনে গভর্নর বলেন, ‘ইসলামি ব্যাংকগুলোকে একদম নতুন রূপ দেওয়া হবে। একটি বড় ও অনেকগুলো ছোট ছোট ইসলামি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো সমস্যাগ্রস্ত। এসব ব্যাংক একীভূত করে বড় দুটি ইসলামি ব্যাংক গড়ে তোলা হবে।’ গভর্নরের এসব বক্তব্য নেতিবাচক হিসেবে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ব্যাংকাররা। তারা মনে করছেন, এসব বলার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে ভীতি তৈরি হচ্ছে। এসব ব্যাংকের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। তাই ব্যাংক খাত নিয়ে সরাসরি দুর্বল-সবল মন্তব্য না করার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিগত সময়ে নানা অনিয়ম লুটপাটের কারণে ইসলামি ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের ব্যাপক আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। গত সরকারের সময়ে এস আলম গ্রুপ দেশের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকটি ইসলামি ব্যাংকের মালিকানা নিয়েছিল এবং আরও কয়েকটি ইসলামি ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়ে সেগুলো ফেরত প্রদান না করে বিদেশে পাচার করেছে। এখন সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলাতে হবে। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। আর নতুন করে যেন কোনো অনিয়ম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলে এসব ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে।’
টিএই/জেবি