- এক বছরে প্রায় ৫৭ হাজার কোটির ঋণ পুনঃতফসিল
- তিন মাসে পুনঃতফসিল ৩৬ হাজার কোটি টাকা
- খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাংক খাতে লুটপাটের একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল ঋণ পুনঃতফসিল। বিভিন্ন মেয়াদি ঋণ পুনঃতফসিল করে ঢেকে রাখা হয়েছিল খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র। অনৈতিকভাবে সুযোগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ ও লুটেরা গোষ্ঠীকে। মাঝখানে কিছুটা কমলেও আবারও পুনঃতফসিলের হিড়িক দেখা গেছে দেশের ব্যাংকগুলোতে। তিন মাসে প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এছাড়া এক বছরে ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এত বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিলের পরও একই সময় খেলাপি ঋণ প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সাধারণত ঋণ পুনঃতফসিল হচ্ছে, কোনো একটি ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময়সীমাকে এগিয়ে নিয়ে আসা বা পিছিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ সময় বাড়িয়ে দেওয়া। তবে, আমাদের দেশে এই পদ্ধতি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেই প্রায় শতভাগ ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসে সর্বনিম্ন পুনঃতফসিল হলেও ডিসেম্বরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এরমধ্যে ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে জুলাই মাসেই সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট ৩৫ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। যেখানে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুনঃতফসিলের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। আর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট সাত হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছিল।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের ভোটের আগে রেকর্ড খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২২ সালে ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালা শিথিল করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এরপর ঋণ নিয়মিত করার প্রবণতা যেন লাফিয়ে বাড়ে।
বিজ্ঞাপন
তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করা। তার আগের বছর পুনঃতফসিল হয় ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ২৬ হাজার ৮১০ কোটি এবং ২০২০ সালে ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।
আওয়ামী শাসনামলের সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণ কমাতে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ১২ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুবিধা নিয়ে অনেকেই ঋণ পুনঃতফসিল করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেসব ঋণই এখন খেলাপি হচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বার বার পুনঃতফসিল করার কারণে খেলাপি ঋণ চাপা পড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্স ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আগে বিভিন্ন গ্রুপকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য বারবার ঋণ রিসিডিউল করা হয়েছে। এখন তো সেটা বন্ধ হওয়ার কথা। বারবার পুনঃতফসিলের নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যারা পাচার করেছে তাদের টাকা ফিরিয়ে আনতে হবে। সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। জনগণের টাকা জনগণকে ফিরিয়ে দিলে ব্যাংকের ওপর আস্থা ফিরবে।
অন্যদিকে পুনঃতফসিলের পরও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মধ্য খেলাপি ঋণ পরিণত হয়েছে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২০ দশমিক ২ শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। এই হার আগের প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) থেকে কিছুটা বেড়ে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই হার ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে।
টিএই/জেবি