images

অর্থনীতি

হতাশায় গ্রাহকরা, কী হচ্ছে আইসিবি ব্যাংকে?

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

২০ মে ২০২৪, ০৮:৪২ পিএম

অফিস আছে, কর্মকর্তা আছে, আছে গ্রাহক ও আমানতকারী, কিন্তু নেই টাকা। অর্থ সংকটে অনেকটা দেউলিয়ার মতো অবস্থা আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের। প্রায় দুই মাস ধরে ব্যাংকটিতে নগদ টাকার সংকট। এতে বিপাকে পড়েছেন নানা শ্রেণি-পেশার গ্রাহকরা। অনেকেই চিকিৎসাসহ জরুরি প্রয়োজনে টাকা তুলতে গিয়েও ফিরছেন হতাশ হয়ে। ক্যাশ টাকা না থাকায় চাহিদানুযায়ী সেবা দিতে পারছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এ ব্যাপারে তারা অসহায়।

সরকার ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহিত করতে ক্যাশলেস বাংলাদেশের কথা বললেও অর্থ সংকটে ক্যাশলেস অবস্থা আইসিবির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় বিতরণ করা ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় ডুবছে ব্যাংকটি। এখনই কোনো পদক্ষেপ না নিলে এর প্রভাব পড়তে পারে ভালো ব্যাংকগুলোর ওপর।

রোববার (১৯ মে) দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চে গিয়ে দেখা যায়, ব্রাঞ্চ অনেকটাই ফাঁকা। পাওয়া যায়নি ম্যানেজার, সেকেন্ড ম্যানেজারকে। তবে সেখানে কর্মরত একজন বলেন, ‘অবস্থা যা দেখতেছেন তাই। কিছুদিন ধরে সমস্যা চলতেছে। গ্রাহকদের ঠিকমত টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। স্যারেরা এটা নিয়ে কাজ করছেন।’

এই শাখায় এক মাসে তিনবার এসেও দীর্ঘদিন থেকে জমানো সঞ্চয় ফেরত পাননি ইতালি প্রবাসী আফসার উদ্দিন। এমনকি এই শাখার ম্যানেজারকেও খুঁজে পাচ্ছেন না এই গ্রাহক।

একই অবস্থা পল্টনে অবস্থিত ভিআইপি রোড শাখাতেও। তিন মাস আগে পাঁচ বছর মেয়াদী সঞ্চয় স্কিমের মেয়াদ শেষ হলেও টাকা পাননি খাইরুল ইসলাম। দফায় দফায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে নানা অজুহাতে। ‘মাত্র দুই লাখ ৯৫ হাজার টাকা দিতেই যদি এমন করে, তাহলে এই ব্যাংকের ওপর কীভাবে বিশ্বাস রাখি?’ ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন খাইরুল ইসলাম।

আরও পড়ুন

টাকা নিয়ে ‘উধাও’ কর্মকর্তা, ‘উদাসীন’ ব্যাংক

পদ্মা ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক, আতঙ্কে আমানতকারীরা

এর আগে গত বৃহস্পতিবার পল্টন শাখায় গিয়ে দেখা যায়, নিজের অ্যাকাউন্টের টাকা উঠাতে ম্যানেজারের পেছন পেছন ঘুরছেন গ্রাহকরা। ব্যাংকে টাকা না থাকায় ম্যানেজারও দিতে পারছেন না সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস। টাকা তুলতে আসা জাকির হোসেন নামে একজন আমানতকারী বলেন, ‘এখানে আমার দুই লাখ ২০ হাজার টাকা আছে। গত এক মাস ধইরা ঘুরাইতাছে। প্রতিদিনই আজকে কয় কালকে আসেন, কালকে কয় পরশু আসেন। এখনো টাকা দিচ্ছে না। তারা বলছে তাদের টাকা নাই, ব্যালেন্স নাই। তারা বলছে, ধৈর্য ধরেন দেখি কী করা যায়। চেষ্টায় আছি হাবিজাবি।’

ICB2

একই সময় আরেক গ্রাহক বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই ঘুরতেছি। আমার টাকাটা জরুরি দরকার। তারা টাকা দিতে পারছে না। শুধু আশ্বাস দেয়। আমাদের দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এটার সুষ্ঠু তদন্ত করে আমাদের গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া হোক।’

ওইদিন এই শাখায় সকাল থেকে যতজন গ্রাহক এসেছেন কাউকেই টাকা দিতে পারনেনি।

শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরের শাখাগুলোতেও দীর্ঘদিন ধরে একই  অবস্থা অবস্থা চলছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। গল মঙ্গলবার মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোডে অবস্থিত আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে দেখা যায়, আব্দুল হামিদ মাহবুব নামে এক গ্রাহক ৫৫ হাজার টাকা ক্যাশ তুলতে গেলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাকে বলেন, এত টাকা নেই। তাদের কাছে তিনি টাকা না থাকার কারণ জানতে চাইলে উত্তরে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকে টাকা সংকট রয়েছে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দেওয়ার জন্য তাকে পরামর্শ দেন কর্মকর্তারা।

এর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত ছমির মিয়া যান তার চিকিৎসা কাজের জন্য ব্যাংকে টাকা তুলতে। কিন্তু ব্যাংক থেকে তাকে বলা হয়, তিনি দশ হাজার টাকার বেশি তুলতে পারবেন না। আবু রায়হান নামের একজন শিক্ষার্থী জানান, তিনি তাদের পরিবারের জন্য এক লাখ ৬০ হাজার টাকা তুলেছেন প্রতিদিন দশ হাজার টাকা করে। এতে তার অনেক দিন সময় লেগেছে।

আরও পড়ুন

একের পর এক শাখায় ‘লুট’, ব্যাংকের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

কৃষকের ঋণেও খেলাপির থাবা

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমরা শুনেছি এই পরিস্থিতির কথা। ব্যাংকে ৫০ কোটি টাকাও নাই, আমরা অস্বস্তিতে আছি, আমাদের টাকা দরকার। সাপোর্ট, ফান্ড, সময় পেলে আমরা আবারো ছন্দে ফিরে আসতে পারব বলে আশাবাদী।'

কেন্দ্রীয় ব্যাকের তথ্য অনুযায়ী, গেল ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংকটির ঋণের স্থিতি রয়েছে ৭৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৬৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকাই খেলাপি ঋণ। যা মোট আউট স্ট্যান্ডিংয়ের প্রায় ৮৭ শতাংশ।

২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মো. রজব আলীকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে পাঠানো হয়েছিল। শরিয়াহভিত্তিক এই ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োজিত পর্যবেক্ষক থাকা সত্ত্বেও আর্থিক অবস্থার এই দশা হয়েছে। কোনো উন্নতি হয়নি ব্যাংকটির।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রজব আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই বিষয়গুলা পর্যবেক্ষক লেভেল থেকে হ্যান্ডেল করা হয় না। অবজার্ভারের মূল কাজটা হচ্ছে তিন মাস পরপর তাদের যে বোর্ড মিটিং হয় সেটাতে তারা নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু উত্থাপন করল কি না সেটা দেখা। আমাদের আর কিছু কিছু করণীয় নেই। তবে ব্যাংকটার অবস্থা ভালো না। এটা আমাদের ডস এবং বিআরপিডি মনিটর করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিদিন আপটুডেট তথ্যটা নিচ্ছে। ব্যাংকটা যে দুর্বল এতটুকু আমরা জানি। বর্তমান যে অবস্থা চলছে, এটার বিষয়ে তারা কী সিদ্ধান্ত নিছে এটা আমার জানা নাই।’

আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শুরুটা হয় ‘আল-বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে। এরপর ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’, এখন তা ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’ নামে পরিচিত। জানা গেছে, সুদমুক্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৭ সালের ২০ মে ‘আল-বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে কার্যক্রম শুরু। ২০০৪ সালে মালিকানা পরিবর্তন করে নাম দেওয়া হয় ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’। মালিকানা হস্তান্তরের পর ২০০৬ সালে সীমাহীন ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ব্যাংকটিতে। ভুয়া নথি আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে তৎকালীন উদ্যোক্তারা হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। চলে নজিরবিহীন লুটপাট। ফলে ব্যাংকটির পরিচালনাপর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। শৃঙ্খলা ফেরাতে সেখানে প্রশাসক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন করে পুনর্গঠন করতে হয় ব্যাংকটি। বিক্রি করা হয় বিদেশি একটি গ্রুপের কাছে। ২০০৮ সালে ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’ নাম পরিবর্তন করে ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’ রাখা হয়। কিন্তু তারপরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ব্যাংকটি। আর্থিক অবস্থারও উন্নতি হয়নি।

ICB3

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'আমানতকারীদের টাকা দিতে না পারলে এসব ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এসব ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া। গ্রাহকরা যখন টাকা তুলতে পারবে না, হায় হুতাশ করবে, এর একটা প্রভাব ভালো ব্যাংকগুলাতেো পড়বে। কেন এই অবস্থা হবে? এটা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর দায় এড়াতে পারে না। কিন্তু তারা দায় এড়িয়ে চলছে। বিনিয়োগকারীদের সতর্ক হতে হবে। গ্রাহকদের জানানো উচিত, তারা যেন এসব ব্যাংকে টাকা না রাখে।'

আরও পড়ুন

ব্যাংক একীভূত হওয়া নিয়ে ‘হ-য-ব-র-ল’

‘স্বেচ্ছায়’ মার্জারের কথা বলে ‌‘নির্দেশ’ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক?

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ব্যাংক ডিপোজিটরদের টাকা দিতে না পারলে সেটার অস্তিত্ব রাখাই উচিত না। এই বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভালোভাবে দেখা উচিত। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে মানুষের আগ্রহ কমে যেতে পারে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের একটা আইনি জটিলতা আছে, তাদের শেয়ার নিয়ে আদালতের একটা অবজারবেশন আছে। এজন্য রিস্ট্রাকচারিংটা তারা করতে পারছে না। এই অবস্থা চলছে। আর তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যে টাকাটা পাবে সেই টাকা ফেরতের একটা প্রক্রিয়া চলছে। আমরা নিজেরাও কথা বলেছি। আলাপ আলোচনা চলছে। আইনি জটিলতা থাকায় আমরা কোনো স্টেপ নিতে পারছি না।’

টিএই/জেবি