শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

টাকা নিয়ে ‘উধাও’ কর্মকর্তা, ‘উদাসীন’ ব্যাংক

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

টাকা নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী উধাওয়ের দায় কি ব্যাংক এড়াতে পারে?

দেশে প্রায় সময়ই ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং থেকে টাকা নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উধাও হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন কৌশলে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা নিয়ে লা-পাত্তা হচ্ছেন এসব অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। পিয়ন থেকে শুরু করে শাখা-উপশাখার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও এসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে এজেন্ট ব্যাংকিং শাখাগুলোতে।

হরহামেশা এসব ঘটনা ঘটলেও অনেকটা উদাসীন দেখা গেছে এসব ব্যাংকের হেড অফিসকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনার দায় ব্যাংক কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আস্থা হারাবে ব্যাংকগুলো। গ্রাহকদের টাকা অবশ্যই গ্রাহকদের ফিরিয়ে দিতে হবে।


বিজ্ঞাপন


গেল জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে কিশোরগঞ্জের নিকলীতে গ্রাহকদের প্রায় দেড় কোটি টাকা নিয়ে দেশের একটি  শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট উধাও হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন ধরে চড়া সুদের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা জমা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। স্থানীয় ইউপি সদস্য হওয়ায় নিশ্চিন্তে টাকা সঞ্চয় করেন অনেক গ্রাহক। শুধু তাই নয়, টাকা ফেরতের নাম করে গ্রাহকদের কাছ থেকে আগেই নিয়ে রেখেছিলেন টাকা জমার রসিদ। এতে একেকজন গ্রাহকের লাখ লাখ টাকা গচ্চা গেলেও তারা কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এ অবস্থায় সহায়-সম্বল হারিয়ে পথে বসেন অনেকেই।

আরও পড়ুন

খেলাপি ১৬ শতাংশ, সিঙ্গেল ডিজিটে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ

স্থানীয়রা জানান, বছরখানেক আগে দামপাড়া বাজারে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শাখা খুলেছিলেন ইউপি সদস্য আবুল কালাম আজাদ। ১১ শতাংশ সুদের প্রলোভন দেখালে তারা সেখানে টাকা সঞ্চয় করেন। গত ১৯ জানুয়ারি লাভসহ টাকা ফেরত দেওয়ার তারিখ দিয়ে আবুল কালাম আজাদ উধাও হয়ে যান। ফেরতের নাম করে টাকা জমার সব রসিদও নিয়ে রাখেন। যে কারণে এখন মামলা করার মতো তথ্য-প্রমাণও তাদের হাতে নেই। গ্রাহকদের দাবি অনুযায়ী, আত্মসাৎ করা টাকার পরিমাণ দেড় কোটি টাকার বেশি।

গত বছরের মার্চ মাসে একই জেলার হোসেনপুর উপজেলায় গ্রাহকের প্রায় ২০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হন একই ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং উদ্যোক্তা মো. আলমগীর। তখন ব্যাংকটির কিশোরগঞ্জ শাখায় যোগাযোগ করা হলে শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, ‘এজেন্ট ব্যাংক শাখায় কেউ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করলে মূল শাখায় এর সব দায়দায়িত্ব থাকে। এতে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু হোসেনপুর এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যেটা হয়েছে, সেটা হলো তারা (গ্রাহক) আলমগীরের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে লেনদেন করেছেন। তারা (ব্যাংক কর্তৃপক্ষ) এর দায়দায়িত্ব নেবেন না।’


বিজ্ঞাপন


চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও একই ঘটনা ঘটে নরসিংদীর রায়পুরায়। একই ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কয়েক কোটি টাকা নিয়ে উধাও হন শাখা পরিচালক। পরবর্তী সময়ে ‘চাপ’ সইতে না পেরে বিষপানে আত্মহত্যা করেন এরিয়া ম্যানেজার আব্দুল কাইয়ুম (৪৫)। রায়পুরার ৩০টি এজেন্ট শাখা তার অধীনে ছিল।

জানুয়ারি মাসে আরও একটি ঘটনা ঘটে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। আরও একটি বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখায় শত শত গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করে উধাও হওয়ার অভিযোগ ওঠে ম্যানেজার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। গ্রাহকদের অভিযোগ, গেল ২৬ ডিসেম্বর তারা অফিসে তালা লাগানো দেখতে পায়। পরে একজন গ্রাহক ফোন করলে তারা অসুস্থতার কথা বলে এক সপ্তাহ পরে ব্যাংক খুলবে বলে জানায়। এক সপ্তাহ পরেও ব্যাংকে তালা মারা দেখতে পেয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খোঁজখবর নিতে থাকে। এরপর বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে জানতে পারে, ওই ব্যাংকের ঝাটুরদিয়া শাখার ম্যানেজার অলোক মন্ডলসহ তার সহযোগীরা পালিয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে গ্রাহকরা জানতে পারেন, তাদের কোটি কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নিঃস্ব হন অনেক গ্রাহক।

আরও পড়ুন

‘খেলাপিরা যতই শক্তিশালী হোক, ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে হবে’

গেল বছরের আগস্ট মাসে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার একটি সরকারি ব্যাংকের জয়নগর বাজার শাখার ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ মফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাংকের তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় ব্যাংকটির গোপালগঞ্জ জোনাল অফিসের ডিজিএমকে দায়িত্বহীনতার দায়ে বদলি করা হয়েছে। শাখাটির নতুন ব্যবস্থাপক ফাইজুর রহমান পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের ইমিগ্রেশন শাখায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। একই বছরের জুলাই মাসে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর শাখায় গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার কথা বলে শতাধিক গ্রাহকের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হন একটি সরকারি ব্যাংকের পিয়ন রঞ্জু আকন্দ। বিষয়টি টের পাওয়ার পর ভুক্তভোগী গ্রাহকরা ম্যানেজারের অফিস ঘেরাও করেন। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

শুধু এই দুই চারটি ঘটনা নয়, দেশে হরহামেশা এই ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে সবচেয়ে বেশি। সাধারণত গ্রামের সহজ সরল মানুষ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক হয়ে থাকেন। তাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অ্যাকাউন্ট করানো হয়। পরবর্তী সময়ে সেই সুযোগ নেন অসাধু কিছু কর্মকর্তা। প্রতারকরা অনেক কৌশলে এসব প্রতারণা করে থাকেন। তারা বিভিন্ন জালিয়াতির আশ্রয় নেন। গ্রাহকদের জাল রশিদ দেন। এছাড়াও বিভিন্নভাবে টাকা হাতিয়ে নেন। এতে মূল প্রমাণাদি না থাকায় টাকা পান না বেশিরভাগ গ্রাহক। গুটি কয়েক অসাধু কর্মকর্তার কারণে পুরো ব্যাংকি সেক্টরকেই প্রশ্নে মুখে পড়তে হচ্ছে। এরপরেও প্রধান কার্যালয়গুলোতে উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে।

উপরের কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শীর্ষ একটি বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এসব ঘটনায় আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। মামলা করেছি। গ্রাহকরা তাদের টাকা জমা দেওয়ার প্রমাণ দেখাতে পারলে সেটার দায়-দায়িত্ব অবশ্যই ব্যাংক নিয়ে থাকে।’ এর বাইরে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

আরও পড়ুন

কেমন যাবে চব্বিশের অর্থনীতি

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একজন কর্মকর্তা বা ব্যাংকের এজেন্ট তো ব্যাংকই নিয়োগ দিয়ে থাকে। তাই গ্রাহকের টাকা নিয়ে উধাও হলে এর দায়িত্ব অবশ্যই ব্যাংককে নিতে হবে। কারণ ব্যাংকই তো তাকে নিয়োগ করেছে। ব্যাংক কখনোই এর দায় এড়াতে পারে না। ব্যাংক কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ব্যাংকিংয়ের প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে না। এজেন্ট ব্যাংকিং আমাদের দেশের রুট লেভেলের মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। গুটিকয়েক অসাধু ব্যক্তির জন্য এই ব্যাংকিং বন্ধ হতে পারে না। ব্যাংককে সব হিসাব-নিকাশ করেই এজেন্ট কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এজেন্ট ব্যাংকিয়ের জন্য একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই এই নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকিং পরিচালনা করতে হবে। গ্রাহক বা ডিপোজিটররাও এই নীতিমালা অনুযায়ী আমানত ফেরত পাবেন। গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে। তারা যেন টাকা দিয়ে সঠিক রশিদ বুঝে নেন।’

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর