- সব ব্যাংকেই নিরাপত্তা জোরদার
- ঈদের আগে বান্দরবানে সব ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ
- হামলার অন্য উদ্দেশ্য আছে কি না খতিয়ে দেখার আহ্বান
দেশে প্রথমবারের মতো দুই দিনে তিনটি ব্যাংকে ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাতে সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা উপজেলা শাখায় হামলা করে। এ সময় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা নিতে না পারলেও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র লুট করে একং ব্যাংক ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
তার একদিন পরই বুধবার (৩ এপ্রিল) দিনদুপুরে বান্দরবানের থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে শাখায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে অর্থ লুট করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্যরা (কেএনএফ)। এছাড়া মঙ্গলবার কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ইসলামী ব্যাংকের এক এজেন্ট শাখায় জানালার গ্রিল ও ভল্টের তালা ভেঙে প্রায় পাঁচ লাখ ২৭ হাজার টাকা চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় ওই শাখার সিসিটিভির ডিভিআরও খুলে নেয় দুর্বৃত্তরা।
এসব ঘটনায় ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরপর ব্যাংকে হামলা ও লুটের এসব ঘটনা ঘটলেও নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা শুধু স্থানীয় প্রশাসনের বলে দায় সারছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে যে শুধু ব্যাংক লুট করাই নয়, ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তারা এত গুছিয়ে একটা কাজ করল, ব্যাংকের ভেতরেও তাদের সোর্স আছে কি না খতিয়ে দেখা দরকার।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে রুমা উপজেলায় লোডশেডিংয়ের সময় অর্ধশতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সোনালী ব্যাংকের গ্রিল ভেঙে প্রবেশ করে। এ সময় অস্ত্রের মুখে ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা লুট এবং ব্যাংকের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের মারধর করে ১৪টি অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। এ সময় ব্যাংক ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে পরে সিআইড জানিয়েছে, ব্যাকের ভল্ট খুলতে না পারায় সন্ত্রাসীরা কোনো টাকা নিতে পারেনি।
বিজ্ঞাপন
এর রেশ কাটতে না কাটতেই বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার পর বান্দরবানের থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় কেএনএফের (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) ৩০ জনের সশস্ত্র দল হামলা চালায়। ঘটনার সময় আতংকে উপজেলার সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীসহ স্থানীয়রা পালিয়ে যায়। ঘটনার পর উপজেলাটির বাজারে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। অনেকে পালিয়ে সাঙ্গু নদীর তীরে আশ্রয় নেয়।
নিরাপত্তার কারণে বান্দরবান সদরসহ ছয়টি উপজেলায় সব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একইসঙ্গে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির ১৯টি এবং খাগড়াছড়ির ৯টি শাখায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সতর্কভাবে লেনদেন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের জিএম (দক্ষিণ) সাইফুল আজিজ জানান, ডাকাতির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের ৬ উপজেলার সব ব্যাংকের কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে।
এদিকে দুই দিন ধরে ব্যাংকে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটলেও অনেকটা দায়সারা বক্তব্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা আইনশৃঙ্খলা ও লোকাল এডমিনিস্ট্রেশনের বিষয় সম্পর্কিত একটা পরিস্থিতি। এটা আমাদের বিষয়ের মধ্যে পড়ে না। সেখানে স্থানীয় প্রশাসন আছে, এটা তাদের বিষয়। আমরা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। তারা যে কার্যক্রম করছে আমরা সেই সম্পর্কে অবহিত আছি।’
সেখানে লেনদেন বন্ধ রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো নির্দেশনা আছে কি না— এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, ‘সেখানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই লেনদেন বন্ধ রয়েছে। সেখানে কিছু নির্দেশনা দেওয়ার অধিকার আমাদের নাই। যেহেতু এটা আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত বিষয় আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে নির্দেশনা দেবে সেভাবেই পারিচালিত হবে।’
তবে এ ঘটনার পর সব ব্যাংকেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেড (এবিবি)। এ বিষয়ে এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা একটি বিশেষ লোকেশনে হয়েছে। সব ব্যাংকই নিজেদের মতো করে সিকিউরিটি বাড়িয়েছে। বিশেষ করে ওই এরিয়ায় যাদের ব্যাংক আছে তাদেরকে আরেকটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমরা আশা করবো সব ব্যাংকই এরকম তৎপরতা দেখাবে এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার ব্যাপার না। কেন না ব্যাংকে যে টাকা পয়সা থাকে, পরিপূর্ণ এনশিউর করা থাকে। গ্রাহকের কোনো ক্ষতি হবে না। তাই গ্রাহকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
আরও পড়ুন
বান্দরবানের ছয় উপজেলায় ব্যাংক কার্যক্রম বন্ধ
মুখে কালি মেখে কমান্ডো স্টাইলে ব্যাংকে ডাকাতি করে সন্ত্রাসীরা
এবার ভরদুপুরে থানচিতে দুই ব্যাংকে ডাকাতি
বান্দরবানে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি, কোটি টাকাসহ ম্যানেজারকে অপহরণ
কুমারখালীতে ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট শাখার ভল্ট ভেঙে চুরি
এদিকে এসব ঘটনা বারবার ঘটলে সারা দেশেই আতঙ্ক তৈরি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, এই ধরনের ঘটনা নিশ্চই উদ্বেগের ব্যাপার। যারা আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে আছেন তাদের বিষয়গুলো দেখা উচিত। যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিৎ।
এই হামলার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রেজাউল করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, এখানে যে শুধু ব্যাংক লুট করাই মুখ্য বিষয়, সেটা আমি মনে করি না। কেএনএফ দীর্ঘদিনের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। পার্বত্য চট্রগ্রামে তাদের ইতিপূর্বের অনেক ইতিহাস আমরা জানি। শান্তিচুক্তির সময় তাদের সাথে একটা সমঝোতা হয়েছিল। যারা এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করে থাকে বা যেই এলাকায় থাকে সেখানে রিলাক্স মুডে থাকার সুযোগ নাই। তাদের সাথে সমঝোতা হোক বা না হোক, সেটার ওপর ভিত্তি করে চুপ থাকাটা ঠিক হয়নি। যারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আছে, তারা প্রকাশ্য যা করে আড়ালে আরও কিছু থাকে। তারা যে ব্যাংক লুট করে করেছে সেটা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা টাকা নিয়ে গেছে, ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে গেছে, অস্ত্র নিয়ে গেছে। তারা তাদের শক্তির জানান দিয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, সেখানে অবশ্যই নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল। এটা একটা পরিকল্পিত কাজ। এখানে স্থানীয়দের পাশাপাশি আমার ধারণা ব্যাংকের ভেতরেও তাদের ইনফরমার থাকতে পারে। এলাকার সাধারণ লোকজনের কাছেও তথ্য থাকতে পারে। এই কাজটার মাধ্যমে তারা কিন্তু তাদের শক্তি জাহির করল। এই কাজটা সহজ ছিল না। এটা একটা সেনসেটিভ এলাকা। জনবহুল এলাকা। সেখানে পুলিশ ব্যারাক, আনসার ব্যারাক। তারা যেভাবে আনসার ক্যাম্পে গিয়ে তাদেরকে নিরস্ত্র করেছে, তারপর ব্যাংকে হামলা করেছে, সবকিছুই তাদের গোছানো। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়— প্রায় এক ঘণ্টা সময় ধরে তারা তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে অথচ কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খবর পায়নি। তারা এত গুছিয়ে একটা কাজ করল আর আমরা সেটা বুঝতে পারলাম না— এটা আমাদের জন্য বড় একটা ব্যর্থতা। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা উচিত।
টিএই