দেশে প্রথমবারের মতো ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে প্রচলিত নিয়মে পরিচালিত দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক। সোমবার (১৮ মার্চ) বেসরকারি খাতের এই দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষরের মথ্য দিয়ে মার্জারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একীভূত কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরে আতঙ্ক বেড়েছে আমানতকারীদের। যার প্রভাবে পদ্মা ব্যাংক টাকা তোলার হিড়িক শুরু হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার দিন ও পরের দিন ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় ভিড় করছেন আমানতকারীরা। তবে স্বল্প আমানতকারীদের টাকা তোলার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
একীভূত কার্যক্রম শুরুর পর মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) ছিল প্রথম কার্যদিবস। রাজধানীর মতিঝিল শাখায় সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকেই গ্রাহকদের আনাগোনা ছিল বেশ। স্বাভাবিক দিনের থেকে আমানতকারীদের ভিড় কিছুটা বেশি ছিল। স্বল্প অঙ্কের টাকা সাথে সাথে দেওয়া হলেও বড় অ্যামাউন্টের জন্য সময় নিচ্ছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। টাকা তুলতে আসা শিমুল দম্পতি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের অল্প টাকা তাই তুলতে এসেছি। সাথে সাথে দিয়ে দিয়েছে। একই সময়ে আরেক গ্রাহক বলেন, পাঁচ লাখ টাকা তোলার জন্য এসেছি, আমাকে দুই দিন পরে আসতে বলেছে।
বিজ্ঞাপন
শুধু টাকা তুলতেই নয়, অনেকেই আসছেন খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। কাঞ্চন নামের এক গ্রাহক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে লেনদেন করি পদ্মা ব্যাংকের সাথে। মার্জারের খবর শোনার পরে খোঁজ নিতে এসেছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন কোনো সমস্যা হবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক আমানতকারী বলেন, আমার আমানত ম্যাচিউর হয়েছে। কিন্তু আজকে টাকা দিল না, সপ্তাহখানেক পরে আসতে বলেছে। আরেক গ্রাহক বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখলে আতঙ্ক তো কিছুটা থাকবেই। তবে যেহেতু এক্সিম ব্যাংকের সাথে এক হয়ে যাচ্ছে তাই সমস্যা নাও হতে পারে। এখন দেখা যাক কী হয়।
এদিকে হঠাৎ করেই টাকা তুলতে আসা আমানতকারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চাপ বেড়েছে কর্মকর্তাদের ওপর। তারাও বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করছেন। এ বিষয়ে মতিঝিল শাখা প্রধান মনির হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘স্বাভাবিকের তুলনায় আমাদের টাকা তোলার চাপ অনেক বেড়েছে। অনেকে ডিপোজিট ম্যাচুরিটি আসার আগেই টাকা তুলতে চাচ্ছেন। স্বাভাবিকের তুলনায় ৫০ পার্সেন্ট ট্রেডিশনাল একটা প্রেসার পড়েছে। কারণ মানুষের মাঝে একটা বিষয় কাজ করছে- টাকা দেবে কি না। এটা স্বাভাবিক। আমরা গ্রাহকদের বোঝাচ্ছি। অনেকে বুঝতেছে। অনেকে বুঝতেছে না। টাকা দিয়ে দিচ্ছি।’
শুধু মতিঝিলই নয়, রাজধানীর আরও বেশ কয়েকটি শাখায় খোঁজ নিয়ে একই অবস্থার কথা জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তারেক রিয়াজ খান বলেন, ‘বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকে এক লাখ ৫০ হাজার হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে গত দুই বছরেই গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজারের মতো। এছাড়া অনেক সংকটের মধ্যে গত তিন বছরে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা আমানত পেয়েছি। তাতে বর্তমানে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ২৪১ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ৬৭ শতাংশ থেকে ৬১ দশমিক ৮৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছি। এছাড়া পাঁচটি ইসলামি উইন্ডো চালু করেছি। গত দুই বছরে দুটি পূর্ণাঙ্গ শাখা এবং ১৪টি উপশাখা বেড়েছে পদ্মা ব্যাংকের। গত পাঁচ বছরে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদের সহযোগিতা ও কর্মীদের দক্ষতার কারণে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ৮৭৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।’
এমডি বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংক এখন একেবারেই প্রান্তিক মানুষকে সেবা দেবে। প্রান্তিক মানুষকে সেবা দিযে তাদেরও স্মার্ট উদ্যোক্তা তৈরি করবে পদ্মা ব্যাংক। বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকের ৬০টি শাখা ও ছয়টি উপশাখা রয়েছে। গত দুই বছরে গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজারের মতো।’
সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর পরবর্তী অনুষ্ঠানে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার জানিয়েছেন, ব্যাংকটিকে একীভূত করার কারণে নতুন কার্যক্রম চলবে এক্সিম ব্যাংকের নামে। একীভূত করা হলেও কোনো এমপ্লয়ি চাকরি হারাবেন না।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, পদ্মা ব্যাংকে একীভূত করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো চাপ ছিল না, তবে সরকারের পক্ষ থেকে পরামর্শ ছিল। আমরা এটা করেছি দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে। পদ্মাকে একীভূত করা হলেও আমানতকারীদের কোনো সমস্যা হবে না, সবাই নিরাপদে থাকবেন।
দেশে ২০১৩ সালে নতুন যে নয়টি ব্যাংক অনুমোদন পায়, তার একটি পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স)। শুরু থেকেই এটির কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন অনুমোদন পাওয়ার আগেই ব্যাংকটি অফিস খুলে লোকবল নিয়োগ দিতে শুরু করে। আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন এর উদ্যোক্তারা। ফলে চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির এমডি একেএম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। পদ্মা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।
২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। এ রকম অবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পদ্মা। এর ফলে ব্যাংকের তালিকা থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংকের নাম। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর জেলে আছেন নির্বাহী কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী এবং তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতী। গত বছরের অক্টোবরে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় তাদের ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বর্তমানে এটি ইসলামি ধারার একটি ব্যাংক। ২০০৪ সালে এটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ইতোমধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক একীভূত করতে পরিচালক পর্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) প্রকাশ করল এক্সিম ব্যাংক।
টিএই/জেবি