মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

‘স্বেচ্ছায়’ মার্জারের কথা বলে ‌‘নির্দেশ’ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক?

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১৫ মে ২০২৪, ০৬:৩১ এএম

শেয়ার করুন:

‘স্বেচ্ছায়’ মার্জারের কথা বলে ‌‘নির্দেশ’ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক?
ফাইল ছবি

দুর্বল ও সবল পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে স্বেচ্ছায় একীভূতের কথা বললেও নির্দেশ দিয়ে বাস্তবায়ন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একের পর এক ব্যাংকের এমডি-চেয়ারম্যানকে ডেকে একীভূত হওয়ার মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ভাষায় যাকে ‘স্বেচ্ছায় একীভূত হতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে চাপ প্রয়োগই করা হবে তাহলে কেন দেওয়া হলো পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক? এভাবে জোর করে ব্যাংক একীভূতকরণ অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মনে করেন তারা।

ব্যাংক খাতের দুরবস্থা কাটাতে অন্তত ১০টি দুর্বল ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার ঘোষণা দেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। এ জন্য গত ডিসেম্বরে একটি দ্রুত সংশোধনমূলক কার্যক্রম ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক’ কাঠামো করা হয়। সেই অনুযায়ী আগামী বছরের মার্চ থেকে বাধ্যতামূলক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। তবে গত মার্চেই এ কার্যক্রম শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

ভারতীয় গণমাধ্যমে রিজার্ভ চুরির খবর ভুয়া: বাংলাদেশ ব্যাংক

তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত যেসব ব্যাংককে ডেকে একীভূত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মধ্যে রয়েছে: এক্সিমের সঙ্গে পদ্মা, সোনালীর সঙ্গে বিডিবিএল, কৃষির সঙ্গে রাকাব, সিটির সঙ্গে বেসিক এবং ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিমের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই হলেও তা নিয়ে এখন পর্যন্ত ব্যাংক দুটির পক্ষ থেকে কোনো বিরূপ মন্তব্য করা হয়নি। তবে একীভূত হতে আপত্তি উঠেছে অন্য সব ব্যাংকের পক্ষ থেকে। যদিও আপত্তি থাকার পরও ইতোমধ্যে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)।

এমওইউ সইয়ের পর সাংবাদিকদের বিডিবিএলের চেয়ারম্যান শামীমা নার্গিস বলেন, বিডিবিএলের চারটি ইনডিকেটরের মধ্যে তিনটিই ভালো আছে, শুধু একটিতে একটু দুর্বল অবস্থায় আছে। সেটি হচ্ছে, খেলাপি ঋণ। আগে যেটা ৪১ শতাংশ ছিল, আমরা সেটা কমিয়ে ৩৪ শতাংশে নিয়ে এসেছি। খেলাপি ঋণ ৬ মাসে ৩৪ থেকে ৫-১০ বা ১৫ শতাংশে আনা সম্ভব নয়। খেলাপি আদায়ে আমাদের তৎপরতা বাড়ালেই চলবে না, যার যে খেলাপি তাকেও এগিয়ে আসতে হবে। সে যদি এগিয়ে না আসে তার জামানত বিক্রি করতে হলেও আমাকে অনেক ধাপে কার্যক্রম চালাতে হয়। অর্থঋণ আদালত, অর্থ আদালত, মামলা এসব ধাপ অতিক্রম করে আসতে হবে। যেটা কোনোভাবেই ৬ মাসে সম্ভব নয়। কাজেই আমি যে সময় নেব, বাংলাদেশ ব্যাংক তো আর আমাকে ৫ থেকে ১০ বছর সময় দেবে না। আমি যদি সেচ্ছায় মার্জারে না যাই তবে ‘ফোর্স’ মার্জারে যেতে হবে।

ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের বক্তব্যে ক্ষোভ ছিলো স্পষ্ট। শুধু তাই নয়, বিডিবিএলের একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপের কারণেই ব্যাংকটি বাধ্য হয়ে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে এমওইউ করতে বাধ্য হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

পাঁচ কোম্পানির ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস নিষিদ্ধ চেয়ে মামলা

আর রাষ্ট্রের অন্য দুই ব্যাংক বেসিক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) তো রীতিমতো একীভূত না হতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দিয়েছে। আর একীভূত না হওয়ার বিষয়ে পর্ষদ সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। একীভূতকরণ নিয়ে জটিলতায় পর পর্ষদের ৪ পরিচালক পদত্যাগ করলে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও একীভূত হতে চায় না ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পর্ষদও।

এদিকে, গত ২ মে রাকাব এবং ৭ মে বেসিক ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জোর করে স্বেচ্ছা একীভূত হওয়ার মৌখিক নির্দেশনার বিষয়টি তুলে ধরেছে। মালিক হিসেবে এ বিষয়ে সরকারের লিখিত মতামত চাওয়া হয়েছে।

বেসিক ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার খবর প্রকাশের পর সরকারি আমানত তুলে নেওয়ায় গভীর সংকটে পড়েছে ব্যাংকটি। চরম তারল্য সংকটের কারণে বন্ড রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার সুযোগও শেষ হয়ে গেছে। গ্রাহকদের আস্থা সংকটের কারণে বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণে (এসএলআর) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর আগে কখনও ব্যাংকটির এসএলআর ঘাটতি হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে যে কোনো মুহূর্তে ‘চেক ডিজঅনার’-এর আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় একীভূতকরণ বিষয়ে মালিক হিসেবে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার, আমানত উত্তোলন বন্ধে নির্দেশনা এবং কম সুদে সরকারি আমানত সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন কমেছে ভারতে

গত ২৫ এপ্রিল রাকাবের পর্ষদ সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনার ভিত্তিতে নয়, একীভূত হতে হলে মালিক হিসেবে সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের লিখিত সিদ্ধান্ত আসতে হবে। আর একীভূত হলে অন্য কোনো দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে নয়, কোনো একটি সবল ব্যাংকের সঙ্গে হোক।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর রাকাবের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে রাকাব ও কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মৌখিকভাবে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে ব্যাংক দুটির পারফরমেন্স পর্যালোচনা করে কৃষি ব্যাংককের সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করতে মৌখিক নির্দেশনা দেন গভর্নর। সে ক্ষেত্রে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাংক দুটির পর্ষদে সেচ্ছায় একীভূত হবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়। পরে রাকাবের চেয়ারম্যান অন্য একটি ব্যাংকের অভিজ্ঞতা দেখে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাকাব দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি ও কৃষকের সার্বিক উন্নয়ন ও উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নে সরাসরি জড়িত।

পাশাপাশি রাকাব তাদের কার্যক্রম ও আর্থিক সূচক তুলে ধরে চলতি বছরের জুনের মধ্যে ব্রেক ইভেনে পৌঁছাবে বলেও উল্লেখ করে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের চাওয়া ও পরিস্কার সিদ্ধান্ত হচ্ছে রাকাব ও বিকেবি জরুরি সভা ডেকে নিজ নিজ সভায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একীভূত হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে রাকাব শতভাগ রাষ্ট্র মালিকানাধীন হওয়ায় একীভূত হওয়ার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিদ্ধান্ত চেয়েছে ব্যাংকটি।

আরও পড়ুন

খাদ্য মূল্যস্ফীতি ফের ১০ শতাংশের ওপরে

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় মার্জ হতে বলেছি। তারা নিজেরা নিজেরা আলোচনা করে আমাদের কাছে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসলে বিবেচনা করব। এটা একটা লং টার্ম প্রসেস। এটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হতে বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়া অতিক্রম হতে পারে। বেশ কিছু পদক্ষেপের পর চূড়ান্তের বিষয় আছে। এখানে আইনগত বিষয় আছে, অডিটের বিষয় আছে। মার্জারের বিষয়ে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হবে আদালতে। এসব প্রক্রিয়া শেষ না হাওয়া পর্যন্ত ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই চলবে।

তিনি আরও বলেন, মার্জারের আলোচনা বা প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় কোনো দুর্বল ব্যাংক যদি সবল হয় সে যদি চায় তারা মার্জারে যাবে না তবে চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত মার্জারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারবে। কোনো কারণে ব্যাংক যদি একীভূত না হয় তবে সেই ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক কার্যক্রম চলবে।

টিএই/এমএইচএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর