মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩২ পিএম
২০২৩ সালের শুরু থেকেই দেশে মার্কিন ডলারের প্রকট সংকট। ব্যবসায়ী, বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসা প্রার্থী অনেককেই ডলারের জন্য হাহাকার করতে দেখা গেছে। এমনকি জরুরি প্রয়োজনে দেশের বাইরে যাওয়া জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ডলার সংগ্রহ করতে পরেননি অনেকে। বছরজুড়ে খোলা বাজারেও ছিল ডলার সংকট, যা এখনও রয়েছে। কোথাও ডলার পাওয়া গেলেও নগদে তা কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১২৪-১২৮ টাকা। ডলার সংকটের কারণে ব্যহত হচ্ছে আমদানি। যার প্রভাব পড়েছে সবকিছুর ওপর। সমস্যা সমাধানে একাধিক পদেক্ষপ নেওয়া হলেও তা খুব বেশি কাজে আসেনি। তবে বছরের শেষ সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে ডলারে।
প্রত্যাশিত রেমিটেন্স কম ও রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি বিল বেশি হওয়ায় কমতে থাকে দেশের রিজার্ভ। তাই গত দেড় বছর ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই চলছে। দেশের বাজারে ডলারের দর নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গেল ১৪ ডিসেম্বর ২৫ পয়সা কমিয়ে ডলার কেনাবেচার নতুন দর ঠিক করেছে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। এর ফলে ডলার কিনতে সেবা খাতসহ সব ধরনের রফতানি আয়, বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্স, আন্তঃব্যাংকে কেনা ডলারের বিনিময় হার হবে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর বিক্রির (আমদানি, আন্তঃব্যাংক, বিদেশে অর্থ প্রেরণ) ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হার হবে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা।
সম্প্রতি নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা নিশ্চিত করতে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সঙ্গে যোগ দেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। বিশেষ অভিযানে বেশি দামে ডলার বিক্রির অপরাধে বেশকিছু মানিচেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত ও সিলগালা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভয়-আতঙ্কে পরিচিত ছাড়া কারো কাছে ডলার বিক্রি করছেন না মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে খোলাবাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়। বিদেশগামী লোকদের নগদ ডলারের প্রধান উৎস এই খোলাবাজার। তবে এখন খোলাবাজারে এসে অনেকেই নগদ ডলার পাচ্ছেন না।
গত অক্টোবর-নভেম্বরে রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকার একাধিক একচেঞ্জ হাউস ঘুরে দেখা যায়, অলস সময় পার করছে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রয়-বিক্রয়ের দাম লেখা আছে বোর্ডে, কিন্তু ডলার নেই। বিক্রেতারা জানান, নির্ধারিত দামে তারা কিনতে পারছেন না, তাই বিক্রিও বন্ধ। তবে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে কোথাও পাওয়া গেলেও নগদ ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা।
বর্তমানে ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৫ টাকার বেশি দরে। এছাড়া ডলার সংকটের কারণে ব্যহত হচ্ছে পণ্য আমদানি। এতে বাজারেও সংকট তৈরি হচ্ছে। ডলারের দরের প্রভাব বাজারজুড়ে। এ বিষয়ে দেশের একটি সুপরিচিত এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) তো ডলারের সরকারি যে রেট সে অনুযায়ী নির্ধারণ করে। কিন্তু কোনো ব্যাংকেই সরকারি ডলারের রেটে এলসি সেটেল হয় না। এর প্রভাব সব জায়গাতেই পড়ে। এজন্য সরকার সরকার এলপিজির যে দর নিধারণ করে দেয় সেই নির্ধারিত দামে আমাদের বিক্রি করা সম্ভব হয় না।’
এদিকে সারা বছর সংকট থাকলেও বছরের শেষ সময়ে এসে ডলারে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। ১৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বিতীয় কিস্তির ঋণের ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার দেশের রিজার্ভে যুক্ত হয়। একই সময় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণও যুক্ত হয় রিজার্ভে। এর ফলে দেশের বর্তমান রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএপের শর্ত (বিপিএম ৬) অনুযায়ী রিজার্ভ ২০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া ডিসেম্বরে বেড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ডিসেম্বরের ২২ দিনে দেশে এসেছে ১৫৬ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স। এতে দৈনিক এসেছে সাত কোটি ১৩ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার।
সবমিলে বছরের শেষের দিকে কয়েকটি সূচকে ইতিবাচক অবস্থানের দিকে দেশের অর্থনীতি। যদিও নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আকু পেমেন্ট রয়েছে। সেখানে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি রিজার্ভ থেকে বের হবে (পেমেন্ট হবে)। এর মধ্যে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি কিছুটা স্বস্তি দেবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আমাদের রিজার্ভকে কিছু সময়ের জন্য স্থিতিশীল রাখবে। এই সময়টাতে হয়তো কমবে না। এটা একটা ভালো দিক। বর্তমান সময়ের জন্য বেশ সহায়ক। তবে ডলারের যে দাম কমেছে এটা বাস্তবসম্মত নয়। দেশে ডলার সংকটের মধ্যে এটা কীভাবে করছে বুঝি না। এভাবে জোর করে টাকার মান বাড়ানো যায় না।’
অপরদিকে বছরজুড়ে ডলার সংকটের পেছনে বেশ কিছু কারণকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। এর থেকে উত্তরণের জন্য বেশকিছু পরামর্শও দেন তারা। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, বর্তমানে ডলারের যে সংকট চলছে, সেটা থেকে উত্তরণের জন্য নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোনোটাই কাজে দেয় নাই। চলমান এই সংকট থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে আমার মতে যেটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে— এক্সচেঞ্জ রেটটা বেঁধে দেওয়া। যেখানে খোলা বাজারে বিক্রি করে ৫-১০ টাকা বেশি পাচ্ছে, তারা তো সেভাবেই পাঠানোর চেষ্টা করবে। যাদের কোনো গতি নাই তারা হয়তো তুলবে। কিন্তু যাদের অপশন আছে যে ইনফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে বিক্রি করলে ৫-১০ টাকা বেশি পাওয়া যাবে, তারা তো সেভাবেই করবে। হুকুম দিয়ে বাজার দর নির্ধারণ করা, এটা থেকে যদি বেরিয়ে আসতে হবে।
তবে এই সংকট যেন ভবিষ্যতে আরও ঘণীভূত না হয় সে জন্য মধ্যমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, কিছু মধ্যমেয়াদি কাজ করতে হবে। রফতানি আরও বাড়ানো যায় কিভাবে সেটা চেষ্টা করা। রেমিটেন্স বাড়াতে হবে। এখন যে ডলারের রেট ফিক্সড করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে আবার রেমিটেন্সের অসুবিধা হচ্ছে। এখন যদি অন্যভাবে টাকা পাঠালে বেশি লাভ হয়, সেজন্য তারা অফিসিয়াল চ্যানেলে বেশি টাকা পাঠাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, স্কিলড লোক পাঠানোর চেষ্টা করতে হবে। তার কারণ হচ্ছে, আমাদের যেসব লোক দেশের বাইরে যায়, তারা বেশিরভাগই আনস্কিলড। কম বেতন পায়, কম রেমিটেন্স পাঠায়। ইম্পোর্টের ক্ষেত্রে দেখতে হবে কিছু ইমপোর্ট রেস্ট্রিকশন করা যায় কি না। সেখানে তো আবার আমাদের বিভিন্ন ‘র’ ম্যাটরিয়ালস, এগুলোরই ইমপোর্ট বেশি। ইমপোর্ট কমালে তখন উৎপাদন ব্যহত হবে, আবার কর্মসংস্থান ব্যহত হবে। তবে বড় কথা হচ্ছে ডলারের রেট ফিক্সড করে দেওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
টিএই