বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

ডলারের অস্থিরতা আর কতদিন?

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১১ আগস্ট ২০২২, ০৩:১৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ডলারের অস্থিরতা আর কতদিন?

আলোচনা টেবিলে বার বার ঘুরে-ফিরে বিষয় এখন একটাই। আর তা হলো ‘ডলার’। সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগের পরও ডলার নিয়ে অস্থিরতা কাটছে না। বরং দিনের পর দিন টাকার মান কমছে, বাড়ছে ডলারের দাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দাম থেকে অনেক বেশি দরে বিক্রিও হচ্ছে। সবশেষ খোলাবাজারে ১১৯ টাকা ছুঁয়েছে এক ডলারের বিনিময়মূল্য। সামনে আরও বাড়বে এমন গুঞ্জনও আছে বাজারে। তাই কোথায় গিয়ে থামবে ডলারের দাম আর সংকট কবে কমবে তা কারো বলার যেন সাধ্য নেই!

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ডলারের এই অবস্থা দিনে দিনে কেটে যাবে এমনটা মনে করার কারণ নেই। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে আমদানির বিষয়ে নির্দেশনাসহ সরকারের নেওয়া উদ্যোগের সঠিক প্রয়োগ, স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের কৌশল ঠিক করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হওয়ার আশঙ্কার কথাও বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যেই ডলার-সংকট নিরসনে সরকার নানামুখি উদ্যোগও নিয়েছে। 


বিজ্ঞাপন


খোলাবাজারে ডলারের সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ১২০ টাকা দিয়েও প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছেন না গ্রাহক। অন্যদিকে দেশে মুদ্রাবাজারের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে টাকার মানের এতটা কম আগে সবশেষ বুধবার (১০ আগস্ট) কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে ৯৫ টাকা দরে। নিয়ম অনুযায়ী এটিই ডলারের আনুষ্ঠানিক দর। এর আগে সোমবার ডলারের দর ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা।

এদিকে আনুষ্ঠানিক দরের বালাই নেই খোলা বাজারে। খোলা বাজারে ১১৫ টাকার বিক্রি হওয়া ডলার মাঝে একদিন আশুরার বন্ধের পর বুধবার এক লাফে পাঁচ টাকা বেড়ে খোলা বাজারে ১১৯ টাকায় পৌঁছেছে। যা দেশের ইতিহাসে খোলাবাজারে সর্বোচ্চ দর। গত সোমবারও এই দাম ছিল ১১৫ টাকা ৬০ পয়সা। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও ১০৮ থেকে ১১০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে ডলার। কিন্তু দামে রেকর্ড হওয়ার পরও ডলার সংকট কাটছে না। এর প্রভাব পড়ছে বিদেশগামী সাধারণ মানুষ, ভোক্তা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবার ওপর।

সংকটের শুরু যেখান থেকে:
মহামারি করোনার ধাক্কার পাশাপাশি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ সব হিসেব এলোমেলো করে দিয়েছে। যুদ্ধের অস্থিরতার কারণে চাপ পড়েছে অর্থনীতিতে। যার কবল থেকে বাদ পড়েনি বাংলাদেশও। করোনার কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে যায়। অবশ্য প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রফতানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। এরপর থেকে যা ক্রমেই বাড়ছে। ইতোমধ্যে রেকর্ড ছাড়িয়েছে ডলারের দাম।

বাজার ‘স্থিতিশীল’ করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিক ডলার বিক্রির কারণে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার হয়েছে। এ সময় রফতানি আয় ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ৯২৫ কোটি ডলারে উঠেছে। রফতানি আয় অনেক বাড়লেও আমদানির সঙ্গে ব্যবধান বেড়েছে। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। একই সময়ে আবার রেমিট্যান্স ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারে নেমেছে। এতে করে চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে ১ হাজার ৮৭০ কোটি ডলারে উঠেছে। আগের অর্থবছর যেখানে ঘাটতি ছিল মাত্র ৪৫৮ কোটি ডলার।

সংকট কাটাতে কী করছে সরকার:
অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ডলার-সংকট নিরসনে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করা হয়েছে। দামি গাড়ি, প্রসাধনী, স্বর্ণালংকার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য বৈদ্যুতিক সামগ্রী, পানীয়সহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ব্যাংক ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমে গেছে।

তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসের তুলনায় গত জুলাই মাসে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩১ শতাংশ। ঈদের কারণে জুলাইয়ে অবশ্য প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। তাতেও ডলারের দাম না কমে, বরং আরও বেড়েছে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে জুলাইয়ের ধারায় রয়েছে রেমিট্যান্সের গতি।

আগস্টের মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৫৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকার অংকে যার পরিমাণ ৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে গড়ে প্রতিদিন দেশে এসেছে প্রবাসীদের পাঠানো ৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। অন্যদিকে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য নানা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। শিথিল করা হয়েছে অনেক শর্ত। বুধবারও মানি এক্সচেঞ্জ সংক্রান্ত দুটি শর্ত শিথিল করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।

dolar

ডলার কারসাজিতে ঠেকাতে কঠোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক:
দেশে ডলার সংকট শুরুর পর কিছু ব্যাংক এই সুযোগ নিতে শুরু করে। সংকটের এই সুযোগে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমদানি পেমেন্টে (এলসি নিষ্পত্তি) ইচ্ছামতো রেট আদায় করে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এক্সেঞ্জ হাউজগুলো ডলার মজুত করে বলেও অভিযোগ উঠে। এছাড়া অনেকেই পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি করে ডলার কিনে মুনাফা করেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। ডলারের দাম আরও বাড়বে- এই আশায় অনেকেই ডলার কিনে রেখেছেন। এসব কারণে ডলার কারসাজি রুখতে কঠোর অবস্থানে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা শুরু করে অভিযান। ইতোমধ্যে ডলার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ছয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশের পর। সোমবার (৮ আগস্ট) পাঁচটি দেশি এবং একটি বিদেশি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অন্যদিকে খোলাবাজারে যারা ডলারের অবৈধ ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধেও হার্ডলাইনে গিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, যারা খোলাবাজারে ডলারের অবৈধ ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জ হাউজের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ৪৫টিকে কারণ দর্শাতে (শোকজ) বলা হয়েছে। শোকজের পাশাপাশি আরও ৯টি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়েই ব্যবসা করে আসছিল।

মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, অনেকের কাছেই এখন নগদ ডলার নেই। কারও কাছে কোনো ক্রেতা এলে যেসব হাউজে নগদ ডলার আছে তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে ক্রেতাকে দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. হেলাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ডলার বিক্রি আর আগের মতো নেই, নগদ ডলারের সংকট রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযান শুরুর পর থেকে মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। এখন চাইলেও যে কেউ এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে ডলার নিতে পারছেন না। এখন অবশ্যই পাসপোর্ট-ভিসা দেখাতে হবে। 

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:
ডলার নিয়ে এমন অস্থিরতা থেকে উত্তরণে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তার সঠিক বাস্তবায়নেও জোর দিয়েছেন তারা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, কেউ জানে না ডলারের রেট কোথায় যাবে। ফলে ডলারের রেট কোথায় যাবে সেটা নিয়ে সবাই চিন্তিত। তবে এটার মূল কারণ হচ্ছে আমাদের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে আমাদের রফতানির বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। যদি রিজার্ভটা বাড়াতে পারি তাহলে ডলারের বাজারের বর্তমান যে অবস্থা আছে তা কাটিয়ে ওঠা যাবে।

সরকার যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে তা যথেষ্ট কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার উদ্যোগ অনেক নিয়েছে কিন্তু এটা বাজারের ওপর নির্ভর করে। সেখানে তো কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। চাহিদা ও যোগানের উপর নির্ভর করে। চাহিদা কমানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু কিছু পণ্যের আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশি যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা ডলারের দাম কমানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে রেমিট্যান্স বাড়ানোর ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে- সেগুলো কিভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে মির্জ্জা আজিজুল বলেন, এখন তো বলা হচ্ছে কোনো ধরণের কাগজপত্র ছাড়াও অর্থ পাঠানো যাবে। দেখা যাক ভবিষ্যতে কোন দিকে যায়। এসবের ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায় কিনা সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে।

বিইউ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর