বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

প্রকট হচ্ছে ডলার সংকট, সুফল মিলছে না পদক্ষেপে

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

dollar
মার্কিন ডলার (ফাইল ছবি)

দেশে অনেক দিন ধরেই চলছে ডলারের সংকট। দিন দিন তা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। জরুরি প্রয়োজনে দেশের বাইরে যেতে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও মিলছে না মার্কিন ডলার। ব্যবসায়ী, বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসাপ্রার্থী সবাই ডলারের জন্য হাহাকার করছেন। বর্তমানে খোলাবাজারেও রয়েছে ডলার সংকট। কোথাও পাওয়া গেলেও নগদ এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৭-১৮ টাকা। বাধ্য হয়ে চড়া দামে ডলার কিনতে হচ্ছে বিদেশগামীদের।

ডলার সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি। যার প্রভাব পড়ছে সবকিছুর ওপর। আবার গেল দুই মাস ধরে ভাটা পড়েছে প্রবাসী আয়ে। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক পদেক্ষপ নিলেও তা খুব বেশি কাজে আসছে না। বরং ডলার পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠছে।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: ডলার সংকট কাটাতে সরকারের যত উদ্যোগ

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে প্রবাসী আয় আরও কমতে পারে। এতে ডলার সংকটের কারণে অনেক আমদানি বাতিল হতে পারে। এতে প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে।

প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি বিল বেশি হওয়ায় কমে গেছে দেশের রিজার্ভ। তাই গত দেড় বছর ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই চলছে। দেশের বাজারে ডলারের এক্সচেঞ্জ দর নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবশেষ গেল সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) ডলারের দর ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। নতুন হার অনুযায়ী, রফতানিকারক ও রেমিট্যান্স পাঠানো ব্যক্তিরা প্রতি ডলারে ১১০ টাকা পাবেন। এছাড়া ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছ থেকে ডলারপ্রতি ১১০ টাকা ৫০ পয়সা নেবে।


বিজ্ঞাপন


কাজে আসছে না কোনো পদক্ষেপ

ডলার সংকট কাটাতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসছে না। সম্প্রতি নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা নিশ্চিত করতে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সঙ্গে যোগ দেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। বিশেষ অভিযানে বেশি দামে ডলার বিক্রির অপরাধে বেশ কিছু মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স স্থগিত ও সিলগালা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভয়-আতঙ্কে পরিচিত ছাড়া কারও কাছে ডলার বিক্রি করছেন না মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে খোলাবাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। বিদেশগামী লোকদের নগদ ডলারের প্রধান উৎস এই খোলাবাজার। তবে এখন এসব মানুষ খোলাবাজারে এসে নগদ ডলার পাচ্ছেন না।

Daller2

রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকার একচেঞ্জ হাউস ঘুরে দেখা যায়, অলস সময় পার করছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা। বেচাকেনার দাম লেখা আছে বোর্ডে, কিন্তু ডলার নেই। বিক্রেতারা বলছেন, নির্ধারিত দামে তারা কিনতে পারছেন না, তাই বিক্রিও বন্ধ। তবে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে কোথাও পাওয়া গেলেও নগদ ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা।

আরও পড়ুন: ডলার সংকটে ধুঁকছে ৫ শিল্প খাত

রাজধানীর পল্টনে বায়তুল মোকাররম মসজিদের বিপরীতে ডজনখানেক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ঘুরেও ডলার পাননি জরুরি প্রয়োজনে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক লতিফুর নামে একজন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কোথাও একশ ডলার পেলাম না। শেষে অনুরোধ করলাম ডলার না দিলেও পাসপোর্ট এনডোর্স করে দিতে, তাও করল না। ডলার ছাড়া পাসপোর্ট এনডোর্স করবে না।’

একই মার্কেটে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অ্যাসোসিয়েশনের ঠিক করে দেওয়া দরে ডলার কেনাও যাচ্ছে না। তাহলে বিক্রি করব কীভাবে? বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে ফোনে যোগাযোগ করলে কেনা যাচ্ছে, যেগুলোর দাম পড়ছে বেশি।’

এদিকে ডলার সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে পণ্য আমদানি। এতে বাজারেও একটা সংকট তৈরি হচ্ছে। ডলারের দরের প্রভাব পড়ছে বাজারজুড়ে। এ বিষয়ে দেশের একটি সুপরিচিত তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) তো ডলারের সরকারি যে রেট সে অনুযায়ী নির্ধারণ করে। কিন্তু কোনো ব্যাংকেই সরকারি ডলারের রেটে এলসি সেটেল হয় না। এর প্রভাবটা সব জায়গাতেই পড়ে। এজন্য সরকার সরকার এলপিজির যে দর নিধারণ করে দেয় সেই নির্ধারিত দামে আমাদের বিক্রি করা সম্ভব হয় না।’

আরও পড়ুন: প্রবাসী আয়ে ভাটা, প্রভাব রিজার্ভে

অপরদিকে গেল দুই মাস ধরে ভাটা পড়েছে প্রবাসী আয়ে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২২ দিনে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে গত মাসের চেয়েও কম প্রবাসী আয় আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। টানা কয়েক মাস ধরে প্রবাসী আয় কম আসায় প্রভাব পড়েছে রিজার্ভেও। গত ২৭ দিনের ব্যবধানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন বা ১৬২ কোটি মার্কিন ডলার। গত বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ৩১ আগস্ট রিজার্ভ ছিল দুই হাজার ৩০৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। যা কমে এখন দুই হাজার ১৪৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে চার কোটি ৭৯ লাখ ৫২ হাজার মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪৪ কোটি ডলার বা ১৫ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। যা তার আগের মাস থেকে প্রায় ১৬ কোটি ডলার কম।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং আগস্টে প্রবাসী আয় আসে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স কমে ৩৭ কোটি ৩৭ লাখ মার্কিন ডলার।

আরও পড়ুন: ডলার সংকটে বিপাকে বিদেশগামী শিক্ষার্থীরা

বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট প্রবাসী আয় আসে দুই হাজার ১৬১ কোটি সাত লাখ মার্কিন ডলার। আগের ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট প্রবাসী আয় এসেছিল দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় আহরণ হয়েছিল, যার পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার।

দর নির্ধারণকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদেরা

ডলার সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে দর নির্ধারণকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলছেন, প্রবাসীরা ভিন্ন পন্থায় ৪-৫ টাকা রেট বেশি পাওয়ার কারণে তারা সেদিকেই ঝুঁকছেন বেশি। এতে রেমিটেন্স হারাচ্ছে দেশ।

Daller3

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে ডলারের যে সংকট চলছে, সেটা থেকে উত্তরণের জন্য নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোনোটাই কাজে দেয়নি। এখন সেখানে যেটা নীতিনির্ধারকদের দেখার বিষয় সেটা হচ্ছে- ফলাফল আমরা কী পেয়েছি সেটা আগে স্বীকার করা। না হলে তো উত্তরণের পথ খুঁজবেন না। আপনি যদি মনে করেন ঠিক করেছেন, সেটা ঠিকই ছিল, তারপরেও হয়নি। আমার কাজ ঠিক আছে।’

আরও পড়ুন: হঠাৎ প্রবাসী আয়ে ভাটা, কারণ কী?

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমার কথা হলো তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হয়েছিল সেটার অকার্যকারিতাকে মেনে নেওয়া। তারপরে সেটাকে শুধরানো। উত্তরণের ক্ষেত্রে আমার মতে যেটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক্সচেঞ্জ রেটটা বেঁধে দেওয়া। এখনো বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতিতে সুস্পষ্টভাবে বলেছে, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তারা একটা মুদ্রা বিনিময় হারের বাজার ফিক্সড করবে। এখনো ১১০ টাকা ৫০ পয়সার বেশি দিয়ে আপনি রেমিটেন্সের ডলার বা এক্সপোর্টের ডলার কিনতে পারবেন না। যেখানে আপনার বাজারদর হচ্ছে ১১৭-১১৮ টাকা, সেখানে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দিয়ে তো আপনার কাছে বিক্রি করতে চাইবে না। যাদের কোনো গতি নাই তারা হয়ত তুলবে। কিন্তু যাদের অপশন আছে যে ইনফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে বিক্রি করলে ৪-৫ টাকা বেশি পাওয়া যাবে, তারা তো সেভাবেই করবে।’

ডলার সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি। যার প্রভাব পড়ছে সবকিছুর ওপর। আবার গেল দুই মাস ধরে ভাটা পড়েছে প্রবাসী আয়ে। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক পদেক্ষপ নিলেও তা খুব বেশি কাজে আসছে না। বরং ডলার পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠছে। 

জাহিদ হোসেন বলেন, ‘হুকুম দিয়ে বাজারদর নির্ধারণ করা- এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে সংকট বাড়বে। এই মাসে রেমিট্যান্সের সংখ্যা দেখেন, এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ১০৫ কোটি ডলার। এই মাসে ১৫০ কোটি ছুতেও কষ্ট হবে। এগুলো থেকে পরিষ্কার হয় না? এত লোক যাচ্ছে, লাখ লাখ লোক বিদেশে কর্মরত। তারা তো তাদের পরিবারের জন্য টাকা পাঠাচ্ছে। এই বিষয়টা চিন্তা করতে হবে।’

আরও পড়ুন: রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডি বন্ধে আইনের প্রয়োগ চান অর্থনীতিবিদরা

তবে এই সংকট যেন ভবিষ্যতে আরও ঘনীভূত না হয় সেজন্য মধ্যমেয়াদী কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কিছু মধ্যমেয়াদী কাজ করতে হবে। রফতানি আরও বাড়ানো যায় কীভাবে সেটা চেষ্টা করা। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। এখন যে ডলারের রেট ফিক্সড করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে আবার রেমিট্যান্সের অসুবিধা হচ্ছে। এখন যদি তারা অন্যভাবে টাকা পাঠালে বেশি লাভ হয় সেজন্য তারা অফিসিয়াল চ্যানেলে বেশি টাকা পাঠাচ্ছে না।’

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘স্কিল লোক পাঠানোর চেষ্টা করতে হবে। তার কারণ হচ্ছে, আমাদের যেসব লোক দেশের বাইরে যায়, তারা বেশিরভাগই আনস্কিল। কম বেতন পায়, কম রেমিট্যান্স পাঠায়। ইমপোর্টের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, কিছু ইমপোর্ট রেস্ট্রিকশন করা যায় কি না। সেখানে তো আবার আমাদের বিভিন্ন রও ম্যাটরিয়ালস এগুলোরই ইমপোর্ট বেশি। ইমপোর্ট কমালে তখন উৎপাদন ব্যাহত হবে, আবার কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে। তবে বড় কথা হচ্ছে, ডলারের রেট ফিক্স করে দেওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর