স্তন ক্যানসারের নাম শুনলে একসময় লজ্জায় মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিলেও আজ নারীসহ সবার মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। তারপরও দেশের ৮০ ভাগ মানুষ এ সম্পর্কে জানে না। যারা সচেতন হয়েছেন বা জেনেছেন তাদের অধিকাংশই (৮০ ভাগ) পরীক্ষার (চেকাপ) আওতায় আসছেন না। ৩২ শতাংশ এর প্রতিকার সম্পর্কে কিছুই জানে না।
সোমবার (১০ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম’ স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবসের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গোলাপি সড়ক শোভাযাত্রা শেষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সাবেক চেয়ারম্যান, নাছিমা বেগম এনডিসি বলেন, স্তন ক্যানসার পোক্ত হওয়ার পরে গিয়ে সমাধান হয় না। প্রাথমিক সময়েই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
বর্তমান চিকিৎসাপদ্ধতির সমালোচনা করে নাছিমা বেগম বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোকে আমাদের ডাক্তারা যথেষ্ট আন্তরিক, কিন্তু ডাক্তার দেখানোর পর দেখা যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে গিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই। গ্রাম থেকে আসা লোকজন সহজেই দালালের খপ্পরে পড়ে যায়। তাই হাসপাতালগুলোর প্রশাসনকে সচেতন হতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ছয়েফ উদ্দিন বলেন, আমাদের ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে অনেকেই ক্যানসারে আক্রান্ত হন। যার প্রমাণ প্রদীপের নিচে অন্ধকার। করোনায় যা প্রমাণ হয়েছে - কারণ আমাদের বহু ডাক্তার-নার্সের অপারেশন করেছি। আমাদের গণমাধ্যম ভাইদের বলবো, আমাদের কারও ক্যানসার হলে গণমাধ্যমে শুরুতেই প্রকাশ না করি। একটা মানুষ মারার আগে না মেরে ফেলি। এমন প্রকাশের কারণেই আমাদের অনেকেই বিদেশে চলে যান, খবরটি গোপন রাখতে। সবশেষ বলবো সচেতন হই।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আমাদের বার্তা লক্ষণ দেখলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সচেতন হোন, বসে থাকবেন না। দেড় লাখ লোক প্রতি বছর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে অন্যতম স্তন ক্যানসার।
বিজ্ঞাপন
দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে স্তন ক্যানসার নিয়ে কাজ করার মতো বা পরিসংখ্যান করার মতো প্রতিষ্ঠান নেই জানিয়ে ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এর জন্য কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান দরকার। সচেতনতার জন্য পাড়া-মহল্লায় সিম্পোজিয়াম-সেমিনার করতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বছরে দেড় লাখ লোক আক্রান্ত হওয়াদের সেবা দেওয়া যাবে না। সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিকার সম্ভবত নয় বলেও জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে উৎযাপন বক্তৃতা দিয়ে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন, আজকের এই সচেতনতা বার্তা কঠিন ছিল। সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে এমন সচেতনতামূলক আয়োজন প্রশংসার দাবিদার। নারীদের জন্য এক মহা আয়োজন। ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ থেকেই বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম কাজ করে যাচ্ছে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার ইপিডেমিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামর প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, শরীরের অন্যান্য স্থানের মতো স্তনে অস্বাভাবিক কোষ বাড়ার কারণে কোনো চাকা বা পিণ্ডের সৃষ্টি হলে তাকে টিউমার বলে। শরীরের বিনা প্রয়োজনে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন থেকে এর সৃষ্টি। প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্তনের টিউমার দুই ধরনের। এক বিনাইন টিউমার-এটা অক্ষতিকারক। উৎপত্তিস্থলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দূরের বা কাছের অন্য কোনো অঙ্গপ্রতঙ্গকে আক্রান্ত করে না। দুই. ম্যালিগন্যান্ট টিউমার আগ্রাসী, ক্ষতিকর। উৎপত্তিস্থলের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা গ্রন্থিকে আক্রান্ত করে। এমনকি রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে দূরের কোনো অঙ্গেও আঘাত হানতে পারে।
অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, স্তন ক্যানসার সাধারণত স্তনের দুধবাহী নালিতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য টিস্যু থেকেও শুরু হতে পারে। একটি পিণ্ড বা চাকা হিসেবেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি প্রথম ধরা পড়ে। ধীরে ধীরে বড় হয়ে শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। স্তনের সঙ্গে কাছাকাছি বগলতলার লসিকাগ্রন্থি বা গ্লাণ্ডগুলোর খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় এগুলোতে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সবার আগে এবং সবচেয়ে বেশি।
অনুষ্ঠানে দেশে স্তন ক্যানসারের ব্যাপ্তি তুলে ধরে আয়োজকরা বলেন, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের নারীরা স্তন ক্যানসারে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন। নারী-পুরুষ মিলিয়ে হিসাব করলেও স্তন ক্যানসারের স্থান শীর্ষে, প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুর হার উভয় ক্ষেত্রেই। প্রতিবছর বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন ১২ হাজার ৭৬৪ জন, মারা যান ছয় হাজার ৮৪৪ জন। নারী ক্যানসার রোগীদের মধ্যে আক্রান্তের ও মৃত্যুর হার যথাক্রমে শতকরা ১৯ ভাগ ও ৭.১৩ ভাগ।
এর আগে ক্যানসারবিরোধী ও নারী সংগঠনসহ ৩৫টি সংগঠনের মোর্চা বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম এ উপলক্ষে সকাল ৯টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে একটি গোলাপি সড়ক শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় রাস্তায় সাধারণ মানুষের কাছে স্তন ক্যানসারের প্রয়োজনীয় তথ্যসমৃদ্ধ একটি বাংলা লিফলেট বিতরণ করা হয়।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মোজাহেরুল হক, অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ, ড. হালিদা হানুম আখতার, ডা. আবু জামিল ফয়সল ও ডা. আব্দুস সবুরসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। অনুষ্ঠানে দশজন সাংবাদিককে স্তন ক্যানসার সচেতনতায় অসাধারণ ভূমিকা রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা স্মারক তুলে দেওয়া হয়। এছাড়া বিশিষ্ট কন্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরীকে স্তন ক্যানসার সচেতনতার শুভেচ্ছা দূত হিসেবে সংবর্ধনা জানানো হয়।
ডিএইচডি/জেবি