শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

রোজার যে আদবগুলো খেয়াল রাখবেন

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৫ মার্চ ২০২৩, ০৩:৩৯ পিএম

শেয়ার করুন:

রোজার যে আদবগুলো খেয়াল রাখবেন

আদব অর্থ শিষ্টাচার। এটি মানুষের জীবনের সৌন্দর্য। প্রত্যেকটি ইবাদতের রয়েছে কিছু আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার। যা ইবাদতকে উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ করে দেয়। কিছু আদব অবশ্য পালনীয়, আর কিছু মোস্তাহাব। যেগুলো আবশ্যক সেগুলো পালন না করলে ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না। আর মোস্তাহাব আদবগুলো ইবাদতের পূর্ণতার সহায়ক এবং ইবাদতের মাঝে কোনো ত্রুটি হয়ে গেলে তা কাটিয়ে ওঠা ও পরিপূর্ণ সওয়াব লাভে সহায়ক। নিচে রমজানের বিশেষ কিছু আদব নিয়ে আলোচনা করা হলো। 

১) সকল প্রকার অন্যায় থেকে বিরত থাকা
রমজানে অযথা কথা-কাজ ও সকল প্রকার অন্যায় থাকতে বিরত না থাকলে সিয়াম কবুলের বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারি: ১৯০৩)
রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার। (বুখারি: ১৯০৪)


বিজ্ঞাপন


রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেছেন, ‘অনেক রোজা পালনকারী রোজা দ্বারা উপোস থাকা ছাড়া আর কিছু পায় না। অনেক রাত জেগে নামাজ আদায়কারী রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছু লাভ করে না।’ (সুনান ইবনে মাজাহ: ১৬৯০)

২) ইখলাসপূর্ণ আমল
ইখলাস ছাড়া কোনো আমলই কবুলযোগ্য নয়। তাই রমজানের রোজাসহ যেকোনো আমল একনিষ্ঠ চিত্তে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও জাকাত দিতে, এটাই সঠিক দ্বীন। (সুরা বাইয়েনা: ৫)

আর সিয়াম পালনে ইখলাসের বিষয়টাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন নবী (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় রমজানের রোজা পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়..’ (সহিহ বুখারি: ১৮৮৭) এই হাদিসে ইহতিসাব শব্দ এসেছে। এর অর্থ ইখলাসের সাথে সিয়াম পালন করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার কাছ থেকে প্রতিদানের আশা করার নাম হল ইহতিসাব।

৩) সুন্নতের অনুসরণ
আল্লাহর রাসুলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা না হলে কোনো আমলই কবুল করা হয় না। বরং তা আল্লাহর দরবারে প্রত্যাখ্যাত। যেকোনো আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য দুটো শর্ত। এক. কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করতে হবে। দুই. কাজটি আল্লাহর রাসুলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে সম্পাদন করতে হবে। অন্যথায় ওই আমলের কোনো সওয়াব নেই। বরং গুনাহ হবে। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে (ইসলাম ধর্মে) নতুন কিছু সৃষ্টি করে, যা তার মধ্যে নেই তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য।’ (সহিহ বুখারি: ২৬৯৭)


বিজ্ঞাপন


যারা সুন্নত অনুযায়ী আমল করে না, কেয়ামতের দিন তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত হবে। সেদিন রাসুল (স.) তাদের হাউজে কাউসারের পানি পান করাবেন না। তিনি তাদের বলবেন, ‘যারা আমার দীনের পরিবর্তন করেছ, তারা দূর হও, দূর হও।’ (বুখারি: ৬৬৪৩)

আরও পড়ুন: বিদআতি লোককে আশ্রয়, যা বলেছেন নবীজি (স.)

৪) রোজা ভঙ্গের সহায়ক বিষয়গুলোও পরিহার করা
শুধু রোজ ভঙ্গ নয়, রোজা ভঙ্গে সহায়ক—এমন কাজ থেকেও দূরে থাকা রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি—এমন অজুহাত শরিয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই অনুমতি থাকলেও স্বামী-স্ত্রীর আলিঙ্গন, চুম্বন বা এক কাঁথা কম্বলের নীচে শয়ন করা ইত্যাদি পরিহার করা রোজা পালনকারীর জন্য বিশেষ আদব।

৫) ভয় ও আশা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করা
ইবাদতকারীর সর্বদা এ ভয় থাকা উচিত যে, হয়ত আমি ইবাদত-বন্দেগি এমনভাবে আদায় করতে পারিনি যেভাবে আদায় করলে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। আবার এ আশাও পোষণ করা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে আমার ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে আমার ইবাদত-বন্দেগি কবুল করে আমাকে প্রতিদান দেবেন। এ অবস্থার নাম হল আল-খাওফ ওয়ার রজা অর্থাৎ ভয় ও আশা। এটা ইসলামের একটা গুরুত্বপূর্ণ আকিদাগত পরিভাষা। মনে রাখতে হবে আল্লাহ তাআলা সবার আমল কবুল করেন না। যেমন তিনি বলেছেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কাজ কবুল করেন।’ (সুরা মায়েদা: ২৭)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আর যারা যা দান করবার, তা ভীত-কম্পিত হৃদয়ে এ কারণে দান করে যে, তারা তাদের পালনকর্তার কাছে ফিরে যাবে। তারাই দ্রুত কল্যাণ অর্জন করে এবং তারা তাতে অগ্রগামী থাকবে।’ (সুরা মুমিনুন: ৬০-৬১)
আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে এই আয়াতের মর্ম জিজ্ঞেস করে বললাম— এই কাজ করে যারা ভীত কম্পিত হবে তারা কি মদ্যপান করে কিংবা চুরি করে? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, না হে সত্যবাদীর কন্যা! তারা হলো যারা সিয়াম পালন করে, সালাত আদায় করে, দান-সদকা করে, সাথে এই ভয়ও রাখে যে হয়ত আমার এই আমলগুলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী থাকে। (আহমদ: ৬/২০৫; তিরমিজি: ৩১৭৫] 

৬) সেহেরি খাওয়া 
রোজা রাখার জন্য সেহেরি খাওয়া সুন্নত। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তোমরা সেহরি খাও। কেননা, সেহরিতে বরকত রয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম: ১/৩৫০)
এছাড়াও রাসুলুল্লাহ (স.)-এর হাদিস অনুযায়ী ‘আমাদের রোজা ও আহলে কিতাবের রোজার মধ্যে পার্থক্য হল সেহরি খাওয়া।’ (মুসলিম: ১০৯৬; আবু দাউদ: ২৩৪৩)
এক ঢোক পানি পান করলেও সেহরির সুন্নত আদায় হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও সেহরি করো। কারণ যারা সেহরি খায়, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।’ (মুসনাদে আহমদ: ৩/১২; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৯০১০; সহিহ ইবনে হিববান: ৩৪৭৬)

আরও পড়ুন: সেহরি কেন এবং কখন খাওয়া উত্তম

৭) শেষ সময়ে সেহরি খাওয়া
রাতের শেষ ভাগে সেহেরি খাওয়া মোস্তাহাব। আল্লাহর রাসুল (স.) সর্বদা শেষ সময়ে সেহেরি খেতেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘সকল নবীকে সময় হওয়ার পরপরই (তাড়াতাড়ি) ইফতার করতে এবং শেষ সময়ে সেহরি খেতে আদেশ করা হয়েছে।’ (আলমুজামুল আওসাত: ২/৫২৬; মাজমাউজ যাওয়ায়েদ: ৩/৩৬৮)
আমর ইবনে মায়মুন আলআওদী বলেন, ‘সাহাবায়ে কেরাম দ্রুত ইফতার করতেন আর বিলম্বে সেহরি খেতেন।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক: ৭৫৯১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৯০২৫)
তবে, ‘সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়—এত দেরি করা মাকরুহ।’ (ফতোয়া আলমগিরি: খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ২০১)

৮) সেহরির সময়কে কাজে লাগানো
নেক আমলের জন্য শেষ রাত একটি মর্যাদা-পূর্ণ সময়। রমজানে এ সময়টি সেহরি হওয়ার কারণে জাগ্রত হতে হয়। তাই অনেক ভালো কাজের সুযোগ রয়েছে এই সময়টিতে। যেমন- সেহেরির আগে তাহাজ্জুদ নামাজ, দোয়া-ইস্তেগফার ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের প্রশংসায় বলেছেন, ‘তারা শেষ রাতে (সেহরির সময়) ক্ষমা প্রার্থনা করে।’ (সুরা জারিয়াত: ১৮)

আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, নবী কারিম (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন; কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দেব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (বুখারি: ১১৪৫)

শেষ রাতের সালাত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো, অভুক্তকে খাবার আহার করাও এবং রাতের বেলা মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাজ আদায় করো। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’ (ইবনে মাজাহ: ১৩৩৪)

৯) সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার
অনতিবিলম্বে ইফতার করা মহানবী (স.)-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। হজরত সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যতদিন মানুষ অনতিবিলম্বে ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের মধ্যে থাকবে’ (সহিহ বুখারি: ১৮২১; সহিহ মুসলিম: ১৮৩৮)। অন্য হাদিসে নবী করিম (স.) বলেছেন—

‘দ্বীন ততদিন পর্যন্ত ঠিক থাকবে, যতদিন পর্যন্ত মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। কেননা, ইহুদি-খ্রিস্টানরা বিলম্বে ইফতার করে’ (আবু দাউদ: ২৩৫৫)

১০) যা দ্বারা ইফতার করা মোস্তাহাব 
পানি পান করে রোজা ভাঙলেও ইফতারের সুন্নত আদায় হয়ে যায়। তবে, খেজুর দিয়ে ইফতার করা মোস্তাহাব। কারণ, মহানবী (স.) খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করতেন। আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (স.) নামাজের আগে কয়েকটি কাঁচা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকত, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। যদি শুকনো খেজুরও না থাকত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে।’(তিরমিজি; রোজা অধ্যায়: ৬৩২)

আরও পড়ুন: খেজুর কেনার আগে চিনে নিন 

উম্মতদেরও তিনি খেজুর দিয়ে ইফতার করতে উৎসাহিত করেছেন। সালমান ইবনে আমির (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ রোজা রাখলে খেজুর দিয়ে যেন ইফতার করে, খেজুর না হলে পানি দিয়ে; নিশ্চয় পানি পবিত্র‘। (আহমদ, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমি; আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৬২, পৃষ্ঠা: ১৩১-১৩২)

পানি, খেজুর এগুলো দ্বারা ইফতার করলে অলসতা সৃষ্টি হয় না। দ্বিতীয়ত পেট পুরে পানাহার ইসলাম সমর্থন করে না। মিকদাম ইবনু মাদিকারিব (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, মানুষ পেটের চাইতে অধিক নিকৃষ্ট কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখে এমন কয়েক গ্রাস খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তার চেয়ে বেশি চাইলে পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে।’ (তিরমিজি: ২৩৮০; মেশকাত: ৫১৯২)

১১) ইফতারের আগে-পরে দোয়া
ইফতারের আগের মুহূর্তটি অতি মূল্যবান। এটি দোয়া কবুলের সময়। নবী করিম (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার যখন সে ইফতার করে ও নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া’ (ইবনে মাজাহ: ১৭৫২)। তিনি আরও বলেছেন, ‘ইফতারের সময় রোজাদের ন্যূনতম একটি দোয়া অবশ্যই কবুল হয়।’ (ইবনে মাজাহ: ১৭৫৩)
হাদিস অনুযায়ী, ইফতারে বেশ আগে থেকে ইফতারি নিয়ে বসে দোয়া-মোনাজাতে মশগুল থাকা দরকার। ইফতারির আয়োজনে ব্যস্ত থেকে অনেকেই এ মোবারক সময়ের দোয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে। এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। ইফতারের আগে গুনাহ ক্ষমার এ দোয়াটি বেশি বেশি পড়া দরকার। يَا وَا سِعَ الْمَغْفِرَةِ اِغْفِرْلِىْ উচ্চারণ: ‘ইয়া ওয়াসিয়াল মাগফিরাতি, ইগফিরলী’ অর্থ: হে মহান ক্ষমা দানকারী! আমাকে ক্ষমা করুন। (শু‘আবুল ঈমান: ৩/৪০৭) 

অতঃপর ‘বিসমিল্লাহি ওয়া আলা বারাকাতিল্লাহ’ বলে ইফতার শুরু করবে এবং ইফতারের পর নিম্নের দোয়া দুটি পড়বে: 
১. اَللّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلي رِزْقِكَ اَفْطَرْتُ উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়ালা রিজকিকা আফতারতু।’ অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য রোজা রেখেছি, এবং তোমারই দেয়া রিজিক দ্বারা ইফতার করলাম। (আবু দাউদ: ১/৩২২) 
২. ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْـتَلَّتِ العُرُوْقُ وَثَبَتَ الاَ جْرُ اِنْ شَاءَ الله تَعَا لى উচ্চারণ: যাহাবাযযমা ওয়াবতাল্লাতিল উরুকু ওয়া সাবাতাল আজরু ইনশাআল্লাহু তায়ালা। অর্থ: পিপাসা দূরিভূত হয়েছে, ধমনীসমূহ সতেজ হয়েছে, এবং ইনশাআল্লাহ রোজার সওয়াব নিশ্চিত হয়েছে। (আবু দাউদ: ১/৩২১)

আরও পড়ুন: দোয়া কবুলের জন্য যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন

১২) কোরআন তেলাওয়াত
রমজান মাসের সঙ্গে কোরআনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই সম্পর্ক এত গভীর যে, রমজানকে কোরআনের মাস বলেই অভিহিত করা হয়। বিশ্বমানবতার মুক্তির পথনির্দেশ হিসেবে রমজান মাসে কোরআন নাজিল করে আল্লাহ কোরআন ও রমজানের মধ্যে সুগভীর সম্পর্ক তৈরি করেছেন। তাই বলা যায়, রমজান মাসে তেলাওয়াত করা হলো কোরআনের অন্যতম হক। ইমাম যুহরি (রহ) বলেন, রমজান হচ্ছে কোরআন তেলাওয়াত ও আহার বিতরণের মাস। (ইবনে আব্দুল বার, আত তামহিদ: ৬/১১১) 

রমজানে নবীজি (স.) অধিক পরিমাণে কোরআন অনুশীলনে ব্যস্ত থাকতেন। কোরআন শিক্ষায় রাসুলের সহপাঠী হওয়ার জন্য জিব্রাইল (আ.) নিয়োজিত ছিলেন। এ বিষয়ে হাদিসে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়— ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, জিবরাইল (আ.) রমজানের প্রতি রাতে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং ফজর অবধি তার সাথে অবস্থান করতেন। (বুখারি: ১৯০২)

শাইখ উসাইমিন বলেন, রমজান মাসে রোজাদারের জন্য কোরআন খতম করা ফরজ নয়। তবে ব্যক্তির উচিত রমজানে বেশি বেশি কোরআন পড়া। এটাই ছিল রাসুলের আদর্শ। গোটা রমজান মাসে জিব্রাইল (আ.) নবী (স.)-এর সাথে কোরআন পাঠ করতেন। (মাজমুউ ফতোয়া, ইবনে উসাইমিন:২০/৫১৬)

১৩) ইবাদত-বন্দেগিতে আল্লাহর তাওফিক কামনা
ইবাদত করার সৌভাগ্য অর্জন আল্লাহ তাআলার এক মহা-অনুগ্রহ। এজন্য ইবাদত-বন্দেগি ও কবুল হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর তাওফিক কামনা রমজানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা উচিত। কত মানুষ ভালো কাজ করে কিন্তু সকলের ভালো কাজ তো কবুল করা হয় না। আল্লাহ মুত্তাকীদের কাজ কবুল করেন। এ ধরনের অনুভূতি থাকলে নেক-আমল করে আত্ম-তৃপ্তি ও অহংকার নামক ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়। কেননা অহংকার ও আত্ম-তৃপ্তি ভালো কাজের প্রতিদান নষ্ট করে দেয়। তখন ভালো কাজগুলো মরীচিকার মতো হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, দুনিয়াতে আমি তাদের কাজের পূর্ণ ফল দান করি এবং তাতে তাদের কম দেওয়া হবে না। তাদের জন্য পরকালে অগ্নি ছাড়া অন্য কিছু নাই এবং তারা যা করে পরকালে তা নিষ্ফল হবে। তারা যা করে তা নিরর্থক।’ (সুরা হুদ: ১৫-১৬)

১৪) দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি মমতা ও সেবা
সিয়াম পালনের মাধ্যমে অসহায় সম্বলহীন অভুক্ত মানুষের প্রতি দয়া ও মমতা সৃষ্টি হয়। তাদের অসহায়ত্ব অনুভব করা যায়। তাই এ দান-প্রতিদানের পবিত্র মাসে তাদের জন্য বেশি করে কল্যাণকর কাজ করা উচিত। ইফতার করানো, সদকাতুল ফিতর, জাকাত আদায় করার সাথে সাথে ব্যাপকভাবে দান-সদকা করা যেতে পারে। হাদিসে এসেছে,  আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমজানে তার দানশীলতা (অন্য সময় থেকে) অধিকতর বৃদ্ধি পেত; যখন জিব্রাইল (আ.) তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। জিব্রাইল (আ.) রমজানের প্রতি রাতে আগমন করতেন এবং তারা পরস্পরকে কোরআন শোনাতেন। আল্লাহর রাসুল (স.) তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন।’ (বুখারি: ০৬; মুসলিম: ২৩০৮; মুসনাদে আহমদ: ২৬১৬)

১৫) সুন্দর চরিত্র, ধৈর্য ও উত্তম আচরণ দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করা
পবিত্র রমজান হলো ধৈর্যের মাস আর সিয়াম হল একটি বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয় থাকাকালীন অবশ্যই সদাচরণ, ধৈর্য, সুন্দর চরিত্রের অনুশীলন করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার। (বুখারি: ১৯০৪)

১৬) অপচয় ও অযথা খরচ থেকে বিরত থাকা
অপচয় তা যে কোনো বিষয়েই হোক ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ। পবিত্র মাসে আমাদের বেশি করে সৎকাজ করা উচিত। তখন আমরা যেন খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অপচয় করে গুনাহে জড়িত না হই। রমজান মাসে দেখা যায় অনেকে অনেক কিছু আয়োজন করে। অবশেষে খেতে না পেরে তা নষ্ট করে ফেলে। এটি অপচয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা অপব্যয় করো না, নিশ্চয় আল্লাহ অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আনআম: ১৪১)

আরও পড়ুন: চুপ থাকায় যত লাভ

১৭) রুটিন করে সময়কে কাজে লাগানো
রমজানের সময়টা অন্য সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সংক্ষিপ্ত। তাই রুটিন করে সময়টাকে কাজে লাগানো উচিত। অন্যথায় অনেক কাজই অসমাপ্ত রয়ে যায়। ফলে অনর্থক কথা-বার্তা, আড্ডা বাজি, গল্পগুজব, নিষ্ফল বিতর্ক বেড়ে যায়। তাই অযথা কথা ও কাজ পরিহার করা সিয়ামের একটি শিক্ষা ও দাবি। অনিয়ন্ত্রিত লাগামহীন কথাবার্তা ঝগড়াঝাটিরও মূল কারণ। তাই যত কম কথা বলা যায় ততই কল্যাণকর। ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, যে নীরবতা অবলম্বন করে সে মুক্তি পায়। (তিরমিজি: ২৪৮৫)

১৮) দুনিয়াবি ব্যস্ততা কমিয়ে দেওয়া
রমজান মাসে নিজের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের জন্য দুনিয়াদারির ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়ে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করা উচিত। অনেকেই রমজান মাসকে অর্থ উপার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুনাফা লাভের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। এ দিকেই বেশি সময় ব্যয় করেন। দুনিয়াদারি যতটুকু না করলেই নয় ততটুকুতো অবশ্যই করবেন। আর বাকি সময়টা আখেরাতের মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যয় করবেন। আখেরাত ভুলে দুনিয়ার প্রেমে যারা পাগল, তাদের ব্যাপারে আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে— যে ব্যক্তি তার সব চিন্তাকে একই চিন্তায় অর্থাৎ আখেরাতের চিন্তায় কেন্দ্রীভূত করেছে, আল্লাহ তার দুনিয়ার চিন্তার জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে যে ব্যক্তি যাবতীয় পার্থিব চিন্তায় নিমগ্ন থাকবে, সে যেকোনো উন্মুক্ত মাঠে ধ্বংস হোক, তাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় না। (ইবনে মাজাহ: ২৫৭)

১৯) খাওয়া ও নিদ্রায় ভারসাম্য বজায় রাখা
খাওয়া-দাওয়া ও নিদ্রায় ভারসাম্য বজায় না রাখলে ইবাদতে ঘাটতি হয়। রমজানে বিষয়টির প্রতি সচেতন হওয়া উচিত। তা না হলে রমজানের জন্য কী আর ত্যাগ করা হলো? মনে রাখতে হবে, মুমিনের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাস রমজান। রোজার প্রতিটি মুহূর্ত মহামূল্যবান। সামান্য অবহেলার কারণে যেন বড় অর্জন থেকে বঞ্চিত হতে না হয় এবং বড় ধরণের ক্ষতির শিকার হতে না হয়। 

২০) জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের অনুসরণ
রমজান কোরআন নাজিলের মাস। এই মাসে আল্লাহ তাআলার প্রত্যেকটি আদেশ-নিষেধের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য রমজানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আদব। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে মুমিনগণ ! তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সুরা বাকারা: ২০৮)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রমজানের গুরুত্ব ও মর্যাদা উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। পবিত্র রমজানের আদবগুলো যথাযথভাবে মেনে চলার তাওফিক দান করুন। পবিত্র মাসকে সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর