নবীজির মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় মদিনাবাসী দীর্ঘ দুই সপ্তাহ ধরে মহানবী (স.)-এর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কুবা গোত্রে অবস্থানের পর যখনই মহানবী (স.) মদিনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন মদিনার ঘরে ঘরে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। নবীজিকে স্বাগত জানানোর জন্য তাঁরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মহানবী (স.) কুবা পল্লী থেকে মদিনা যাত্রা করলেন। সেদিন ছিল শুক্রবার।
বিজ্ঞাপন
মহানবী (স.)-এর সামনে-পেছনে ডানে-বাঁয়ে সারিবদ্ধ মুসলিম জনতা। যখন তিনি বনু সালেম গোত্রের উপত্যকায় গেলেন, জোহর নামাজের সময় হলো। সেখানে তিনি জোহর নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজ। পরবর্তীতে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় এবং তার নাম রাখা হয় মসজিদে জুমা। নবী করিম (স.)-এর স্মৃতিধন্য এই মসজিদের আরেক নাম হলো- ‘মসজিদে আতিকা।’ মসজিদটি কুবা মসজিদ থেকে ৯০০ মিটার উত্তরে এবং মসজিদে নববির ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত।
সেদিন জুমার নামাজে মহানবী (স.) যে খুতবা দিলেন, ইসলামের ইতিহাসে তা-ই ছিল প্রথম খুতবা। খুতবা জুমার নামাজের শর্ত। খুতবা ব্যতীত জুমার নামাজ হয় না। উপস্থিত মুসল্লিদের খুতবা শোনা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে নিরর্থক কাজে মশগুল থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘জুমার দিন খুতবার সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো, ‘চুপ করো’ তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে।’ (সহিহ বুখারি: ১/১২৮)
আরও পড়ুন: জুমার খুতবার সময় দানবাক্স চালানো জায়েজ?
বর্ণিত হাদিস দ্বারা সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়, খুতবার সময় নিশ্চুপ হয়ে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব এবং কথাবার্তা বলা হারাম। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না। (মেশকাত: ৩/৪৩২)।
বিজ্ঞাপন
ইতিহাসের প্রথম জুমার ঐতিহাসিক খুতবাটি মুসলিম উম্মাহর কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সেই ঐতিহাসিক খুতবায় মহানবী (স.) বলেন—
‘সব মহিমা-গরিমা একমাত্র আল্লাহর। তাঁর মহিমা প্রকাশ করি, তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁরই কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করি এবং সৎপথ চেনার শক্তি তাঁর কাছে চাই। তাঁর ওপর ঈমান আনব এবং তাঁর আদেশ অমান্য করব না। যে তাঁর বিদ্রোহী তাকে আপনার বলে মনে করব না।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং এটাও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও প্রেরিত রাসুল। যখন দীর্ঘকাল পর্যন্ত পৃথিবী রাসুলের উপদেশ থেকে বঞ্চিত ছিল, যখন জ্ঞান পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল, যখন মানবজাতি ভ্রষ্টতা ও অনাচারে জর্জরিত, তাদের মৃত্যু ও কঠোর কর্মফল ভোগের সময় যখন নিকটবর্তী হয়ে আসছিল, এমন সময় আল্লাহ তাঁর রাসুলকে সত্যের আলো ও জ্ঞান দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে প্রেরণ করেছেন।
আরও পড়ুন: মহানবী (স.)-এর আদর্শ অনুসরণ ছাড়া মুক্তি নেই
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অনুগত হয়ে চললেই মানবজীবনের চরম সফলতা লাভ হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্য হলে ভ্রষ্ট, পতিত ও পথহারা হয়ে পড়তে হবে।
সবাই নিজেকে এমনভাবে গঠিত ও সংশোধিত করে নাও, যেন পাপজনিত কাজের প্রবৃত্তিই তোমাদের হৃদয় থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তোমাদের প্রতি এটা আমার পরম উপদেশ। পরকালের চিন্তা ও তাকওয়া অবলম্বন করার চেয়ে উৎকৃষ্ট উপদেশ এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে দিতে পারে না। যেসব দুষ্কর্ম থেকে আল্লাহ তোমাদের বিরত থাকতে আদেশ করেছেন, সেগুলোর কাছেও যেয়ো না, সাবধান! এটাই হচ্ছে উৎকৃষ্ট উপদেশ, এটি শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান।
আল্লাহ সম্পর্কে তোমার কর্তব্য আছে। তাঁর সঙ্গে তোমার যে সম্পর্ক আছে, তুমি তা ভুলে যেয়ো না। সে ব্যাপারে যেখানে ত্রুটি ঘটে যায়, তুমি প্রকাশ্যে ও গোপনে তার সংশোধন করো, তোমার সে সম্পর্ককে তুমি দৃঢ় ও নিখুঁত করে নাও—এই হচ্ছে জ্ঞান ও পরজীবনের চরম সম্বল।
স্মরণ রেখো, এর ব্যতিক্রম হলে তোমরা কর্মফলের সম্মুখীন হতে ভীত হলেও তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই। আল্লাহ প্রেমময় ও দয়াময়। তাই এই কর্মফলের অপরিহার্য পরিণামের কথা আগে থেকেই তোমাদের জানিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছেন। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের কথা সত্যে পরিণত করবে, নিজের প্রতিজ্ঞা পালন করবে, তার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমার বাক্যের রদবদল নেই এবং মানুষের প্রতি অত্যাচারীও নই।’
অতএব, তোমরা মুখ্য-গৌণ, প্রকাশ্য-গুপ্ত সব বিষয়েই তাকওয়ার সন্ধান করো। তাকওয়াই পরম সম্পদ, তাকওয়াতেই মানবতার চরম সাফল্য।
আরও পড়ুন: তাকওয়া অর্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
সংগত ও সংযতভাবে পৃথিবীর সব সুখ উপভোগ করো, তিনি তোমাদের তাঁর কিতাব দিয়েছেন, তাঁর পথ দেখিয়েছেন। এখন কে প্রকৃতপক্ষে সত্যের সেবক আর কে শুধু মূর্খের দাবিসর্বস্ব মিথ্যাবাদী—তা জানা যাবে। অতএব, আল্লাহ যেমন তোমাদের মঙ্গল করেছেন, তোমরাও সেরূপ আল্লাহর মঙ্গল সাধনে প্রবৃত্ত হও, আল্লাহর শত্রু পাপাচারীদের শত্রু বলে জ্ঞান করো এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। কেননা নিজের কর্মফলে ও প্রকৃতির অপরিহার্য বিধানে যার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী, সে সত্য, ন্যায় ও যুক্তিমতে ধ্বংস হোক। আর যে জীবন লাভ করবে, সে সত্য, ন্যায় ও যুক্তি সহায়তায় জীবন লাভ করুক। নিশ্চয়ই জেনে রেখো- আল্লাহ ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই।
অতএব, সদাসর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করো, আর পরকালের জন্য সম্পদ সঞ্চয় করে নাও। আল্লাহর সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক কী—এ যদি তুমি বুঝতে পারো, বুঝে নিয়ে তা দৃঢ় ও নিখুঁত করে নিয়ে নাও। তাঁকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে তাঁর ওপর আত্মনির্ভর হও। তাহলে তোমার প্রতি মানুষের যে ব্যবহার তার ভার তিনিই বহন করবেন। কারণ মানুষের ওপর আল্লাহরই কর্তৃত্ব প্রচলিত হয়। আল্লাহর ওপর মানুষের হুকুম চলে না। মানুষ তাঁর প্রভু নয়, কিন্তু তিনি তাদের প্রভু। আল্লাহু আকবর, সেই মহিমান্বিত আল্লাহ ছাড়া আর কারো হাতে কোনো শক্তি নেই।’ (সূত্র: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৩/২১৩)