মহানবী (স.)-এর নবুয়তের পর তাঁর প্রতি ঘোর শত্রুতায় লিপ্ত হয় আরবের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। হত্যাচেষ্টা করা হয় অনেকবার। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবিবকে রক্ষা করেন। এটা মূলত মহান আল্লাহর অঙ্গীকারেরই অংশ। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ রক্ষা করেন মুমিনদের, তিনি কোনো বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা হজ: ৩৮)
হিজরতের সময় হত্যাচেষ্টা
হিজরতের সময় মহানবী (স.)-কে নানাভাবে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিল। হিজরতের উদ্দেশ্যে যে রাতে নবীজি (স.) ঘর ছাড়েন, সে রাতেই মক্কার মুশরিক যুবকরা তাঁকে হত্যা করার জন্য ঘরের চারদিকে ঘেরাও করে রেখেছিল। কিন্তু মহানবী (স.) এক মুঠো ধুলা হাতে নিয়ে সুরা ইয়াসিনের প্রথম ৯ আয়াত পাঠ করেন এবং সেই ধুলা মুশরিকদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেন। এতে তারা দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে এবং নবীজি (স.) তাদের চোখের সামনে দিয়ে বের হয়ে যান। (দালায়িলুন নুবুয়ত: ২/৪৬৯)
বিজ্ঞাপন
আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (স.) যখন মক্কা থেকে মদিনার দিকে বের হলেন। তখন সুরাকা ইবনে মালিক তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করল। রাসুলুল্লাহ (স.) তার ওপর বদদোয়া করলে তার ঘোড়া জমিনে দেবে গেল। সে বলল, আমার জন্য দোয়া করুন, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) দোয়া করলেন। (সহিহ মুসলিম: ২০০৯)
আবু বকর (রা.) বলেন, আমি নবী (স.)-এর সঙ্গে (সাওর) গুহায় ছিলাম। তখন আমি মুশরিকদের পদচিহ্ন দেখতে পেয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, যদি তাদের কেউ পা উঠায় তাহলে আমাদের দেখে ফেলবে। তখন তিনি বললেন, এমন দুজন সম্পর্কে তোমার কী ধারণা, যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ। (সহিহ বুখারি: ৪৬৬৩)
বিষমিশ্রিত খাবার খাইয়ে হত্যাচেষ্টা
বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছে নবীজিকে (স.)। খায়বর বিজয়ের পর মহানবী (স.)-কে একজন ইহুদি নারী বিষযুক্ত বকরির গোশত খেতে দেয়। রাসুল (স.) গোশতের কিছু অংশ চিবিয়ে ফেলে দেন। এরপর বলেন, إنَّ هَذَا الْعَظْمَ لَيُخْبِرُنِي أَنَّهُ مَسْمُومٌ ‘এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে, সে বিষমিশ্রিত’। রাসুলুল্লাহ (স.) ওই মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে কৈফিয়ত দিয়ে বলল, আমার উদ্দেশ্য এই ছিল যে- إنْ كَانَ مَلِكًا اسْتَرَحْتُ مِنْهُ، وَإِنْ كَانَ نَبِيًّا فَسَيُخْبَرُ ‘যদি এই ব্যক্তি বাদশাহ হন, তাহলে আমরা তার থেকে নিষ্কৃতি পাব। আর যদি নবী হন, তাহলে তাঁকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে নবীজিকে বলেছিল- أَرَدْنَا إِنْ كُنْتَ كَاذِبًا نَسْتَرِيحُ وَإِنْ كُنْتَ نَبِيًّا لَمْ يَضُرَّكَ ‘আমরা চেয়েছিলাম যদি আপনি মিথ্যাবাদী হন, তাহলে আমরা নিষ্কৃতি পাব। আর যদি আপনি নবী হন, তাহলে এ বিষ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না।’ (বুখারি: ৩১৬৯; আহমদ: ৩৫৪৭, ২৭৮৫)
আল্লাহ তাআলা নবীজিকে (স.) রক্ষা করেন। এই ঘটনায় সাথি বিশর বিন বারা বিন মারুর এক টুকরো চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। বিষক্রিয়ায় তিনি মারা যান। (ইবনে হিশাম: ২/৩৩৭; ফিকহুস সিরাহ: ৩৪৭ পৃ.; হাকেম: ৪৯৬৭)
নামাজরত অবস্থায় আবু জেহেলের আক্রমণ
নানা সময়ে ফেরেশতাদের পাঠিয়ে আল্লাহ তাআলা নবীজিকে নিরাপত্তা দান করেন। একদিন রাসুলুল্লাহ (স.) নামাজ আদায় করছিলেন। এমন সময় আবু জাহেল নবীজির গর্দানকে পদদলিত করার উদ্দেশে তাঁর কাছে এলো। একটু অগ্রসর হয়ে অকস্মাৎ সে রাসুলুল্লাহ (স.) থেকে মুখ ফিরিয়ে দ্রুত পেছনে সরে এলো এবং দুই হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে লাগল। এটা দেখে তাকে প্রশ্ন করা হলো, তোমার কী হয়েছে? উত্তরে সে বলল, আমি দেখেছি যে আমার এবং তাঁর মধ্যে আগুনের একটা প্রকাণ্ড খাদক, ভয়াবহ অবস্থা এবং কতগুলো ডানা। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, সে যদি আমার কাছে আসত, তবে ফেরেশতারা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলত। (সহিহ মুসলিম: ৬৯৫৮)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: হিজরতের সময় যেভাবে আবু জেহেলরা সবাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল
জাতুর রিকা যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে গাছের নিচে বিশ্রামরত অবস্থায় হত্যাচেষ্টা
জাতুর রিকা যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাসুল (স.) একটি গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়েন। তরবারিটি গাছে ঝুলিয়ে রাখেন। এ সময় গাওরাস ইবনুল হারেস নামের এক বেদুঈন তরবারিটি হাতে নিয়ে রাসুল (স.)-কে হুমকি দিয়ে বলে, এবার তোমাকে রক্ষা করবে কে? জবাবে রাসুল (স.) দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘আল্লাহ’। তখন তরবারিটি তার হাত থেকে পড়ে যায়। (বুখারি: ৪১৩৬; মুসলিম: ৮৪৩; মেশকাত: ১৪২২)
হুনায়েনের সংকটকালে শায়বা বিন ওসমান কর্তৃক হত্যাচেষ্টা
হুনায়েন যুদ্ধের সংকটকালে মক্কার নওমুসলিম শায়বা বিন ওসমান সুযোগ পেয়ে রাসুল (স.)-কে হত্যার জন্য তরবারি উঠায়। কিন্তু হঠাৎ এক আগুনের ফুলকি এসে তার চেহারাকে ঝলসে দিয়ে যায়। ফলে তার হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ হয়। রাসুল (স.) তাকে কাছে ডেকে দোয়া করেন। ফলে সে তওবা করে। (জাদুল মাআদ: ৩/৪১২; ইবনে হিশাম: ২/৪৪৪)
১২ জন মুনাফিক কর্তৃক হত্যাচেষ্টা
তাবুক অভিযান থেকে ফেরার পথে এক সংকীর্ণ গিরিসংকটে ১২ জন মুখোশধারী মুনাফিকের দল রাসুলুল্লাহ (স.)-কে নিরিবিলি পেয়ে তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। (মুসলিম: ২৭৭৯; মেশকাত: ৫৯১৭)
আরও পড়ুন: নবীজির জীবনের দুখের বছর
উল্লেখ্য, চারিদিক থেকে এত আক্রমণের পরও তিনি কারো প্রতিশোধ নিতেন না। শত্রুদেরও তিনি ক্ষমা করে দিতেন। ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে তায়েফ ছাড়ার সময় নবী (স.)-এর কাছে আল্লাহ তাআলা পাহাড়ের ফেরেশতা পাঠান এবং তিনি এসে তাঁকে সালাম দিয়ে বলেন, হে মুহাম্মদ, এসব ব্যাপার আপনার ইচ্ছাধীন। আপনি যদি চান, তাহলে আমি তাদের ওপর আখশাবাইনকে (তায়েফের দুই প্রান্তের পাহাড়) চাপিয়ে দেব। উত্তরে নবী (স.) বললেন; বরং আশা করি মহান আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন সন্তান জন্ম দেবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে আর তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। (সহিহ বুখারি: ৩২৩১)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবীজির জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল রাখার এবং দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

