অনেক মুসলমানের মধ্যে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, ঠান্ডা পানি দিয়ে অজু করলে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়, আর গরম পানি ব্যবহার করলে সেই সওয়াব কমে যায়। বিশেষ করে শীতকালে এই প্রশ্নটি বেশি শোনা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই ধারণার পক্ষে কি কোরআন, হাদিস বা গ্রহণযোগ্য ফিকহি কোনো দলিল আছে? বাস্তবতা হলো- এই ধারণাটি মানুষের অনুমানভিত্তিক চিন্তা থেকে এসেছে, শরিয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থেকে নয়।
ইসলামের মূলনীতি: নিয়তই মুখ্য
ইসলামে যেকোনো ইবাদতের মূল্যায়ন হয় নিয়তের ভিত্তিতে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি: ১) এই হাদিস স্পষ্ট করে দেয় যে, অজুর সওয়াব নির্ভর করে আপনি কেন অজু করছেন এবং কতটা ইখলাসের সঙ্গে করছেন তার ওপর; পানির তাপমাত্রার ওপর নয়। গরম পানি হোক বা ঠান্ডা পানি, যদি নিয়ত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়, তাহলে অজুর সওয়াব পূর্ণই হয়।
কোরআনে অজুর বিধান ও পানির তাপমাত্রা
আল্লাহ তাআলা কোরআনে অজুর ফরজসমূহ উল্লেখ করে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন নামাজের জন্য দন্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর)। আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও। (সুরা মায়েদা: ৬) এই আয়াতে কোথাও পানির তাপমাত্রা সম্পর্কে কোনো শর্ত আরোপ করা হয়নি। অর্থাৎ পানি পবিত্র হলেই অজু সহিহ হবে; গরম না ঠান্ডা, সেটি শরিয়তের শর্ত নয়।
বিজ্ঞাপন
হাদিসে গরম পানি ব্যবহারের প্রমাণ
হাদিসে এমন প্রমাণও পাওয়া যায় যে, রাসুলুল্লাহ (স.) প্রয়োজনে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করেছেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবীজি (স.) এমন পানি দিয়ে অজু করেছেন, যাতে গরম পানি মিশ্রিত ছিল। (সুনানে বায়হাকি)। এটি প্রমাণ করে যে, গরম পানি ব্যবহার কোনো অপছন্দনীয় কাজ নয়।
সওয়াব কমে যাওয়ার কোনো দলিল নেই
গরম পানি দিয়ে অজু করলে সওয়াব কমে যায়—এমন কথা কোরআন, সহিহ হাদিস বা ফিকহের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে কোথাও বলা হয়নি। বরং ইমাম নববি (রহ.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘গরম পানি দিয়ে অজু করা মাকরুহ নয় এবং এতে সওয়াব কমে যাওয়ার কোনো প্রমাণ নেই।’ (আল-মাজমু) একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকিহের এই বক্তব্য বিষয়টিকে পরিষ্কার করে দেয়।
আরও পড়ুন: যেসব কারণে গোসল ফরজ হয়
কষ্ট ও সওয়াবের হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা
রাসুলুল্লাহ (স.) এক হাদিসে বলেছেন, ‘সওয়াব কষ্টের পরিমাণ অনুযায়ী বৃদ্ধি পায়।’ (সহিহ মুসলিম)। এই হাদিসের অর্থ এই নয় যে, ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের ওপর কষ্ট চাপিয়ে দিতে হবে। বরং অনিবার্য কষ্টের কারণে যদি ধৈর্য ধারণ করা হয়, তখন অতিরিক্ত সওয়াব অবশ্যই পাওয়া যাবে। এটাই হাদিসের মর্মকথা। কিন্তু শীতের কষ্ট এড়াতে বা প্রয়োজনে গরম পানি ব্যবহার করলে সওয়াব কমে যাবে—এমন ব্যাখ্যা এই হাদিস থেকে বের করা সঠিক নয়।
ইসলাম কষ্ট নয়, সহজতা চায়
ইসলামের একটি মৌলিক নীতি হলো সহজতা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, কঠোরতা চান না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)। আরেক জায়গায় বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের ওপর কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না।’ (সুরা মায়েদা: ৬)
শীতকালে প্রয়োজনে গরম পানি ব্যবহার করা আল্লাহর দেওয়া রহমত ও সহজতার অংশ। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত করতে চান।’ (সুরা নিসা: ২৬)। তাই অহেতুক কষ্টকে দ্বীনদারি মনে না করে শরিয়তের ভারসাম্যপূর্ণ পথ অনুসরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

