মানুষ ভুলের পাত্র, কিন্তু ভুল বুঝে ক্ষমা প্রার্থনা করাই ঈমানদারের সৌন্দর্য। ‘ইস্তেগফার’ অর্থ আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। এটি এমন দোয়া, যা গুনাহ মাফ করে, দুশ্চিন্তা দূর করে, রিজিক বাড়ায় এবং অন্তরকে প্রশান্ত করে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, তারপর তাঁর দিকে ফিরে আসো। নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুন্দরভাবে জীবন উপভোগ করতে দেবেন।’ (সুরা হুদ: ৩)
বিজ্ঞাপন
সাতটি ছোট ইস্তেগফার (সহজ ও দৈনন্দিন আমলের জন্য)
১. মানবজাতির প্রথম ইস্তেগফার: আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর দোয়া
আরবি: رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
উচ্চারণ: রব্বানা জ্বালামনা আনফুসানা, ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা, ওয়াতারহামনা, লানাকূনান্না মিনাল খাসিরীন।
বিজ্ঞাপন
অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। (সুরা আরাফ: ২৩)
মাহাত্ম্য: এটি মানবজাতির প্রথম তাওবা ও ইস্তেগফার, যা অনুতাপ, স্বীকারোক্তি ও আল্লাহর রহমতের উৎকৃষ্ট আশাপ্রকাশ।
২. সংক্ষিপ্ত ইস্তেগফার: নবীজির প্রতিদিনের আমল
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللهَ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লা-হ।
অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মাহাত্ম্য: নবী (স.) ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পর এটি তিনবার পাঠ করতেন। (সহিহ মুসলিম: ৫৯১; সুনানে আবু দাউদ: ১৫১)
আরও পড়ুন: হাদিসের আলোকে সর্বোত্তম ১৭ আমল
৩. তাওবার সঙ্গে ইস্তেগফার
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লা-হা ওয়া আতূবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাঁর দিকেই ফিরে আসি (তাওবা করি)।
মাহাত্ম্য: নবী (স.) বলেছেন, ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের কাছে তাওবা করো। নিশ্চয়ই আমি প্রতিদিন একশতবার তাওবা করি।’ (সহিহ মুসলিম: ২৭০২)
৪. হাদিসে বর্ণিত বিশেষ ইস্তেগফার
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুমু ওয়া আতূবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি সেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; তিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। আমি তাঁর দিকেই ফিরে আসি।
মাহাত্ম্য: রাসূল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই দোয়া পাঠ করবে, তার গুনাহ ক্ষমা করা হবে, যদিও সে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নকারী হয়।’ (আবু দাউদ: ১৫১৭; তিরমিজি: ৩৫৭৭)
৫. মজলিস শেষে পড়ার ইস্তেগফার
আরবি: سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
উচ্চারণ: সুবহা-নাকাল্ল-হুম্মা ওয়া বিহামদিকা, আশহাদু আল্লা ইলা-হা ইল্লা আনতা, আস্তাগফিরুকা ওয়া আতূবু ইলাইকা।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি পবিত্র, আপনারই প্রশংসা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি—আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই এবং আপনার দিকেই ফিরে আসি।
মাহাত্ম্য: ‘নবী (স.) প্রতিটি বৈঠকের শেষে এই দোয়াটি পাঠ করতেন, যাতে কথাবার্তায় কোনো ত্রুটি হলে তা ক্ষমা হয়ে যায়। (আবু দাউদ: ৪৮৫৯; তিরমিজি: ৩৪৩৩)
আরও পড়ুন: সবসময় ইস্তেগফার করলে ১৫ নেয়ামত লাভ হয়
৬. নবী ইউনুস (আ.)-এর দোয়া: সংকট ও বিপদে মুক্তির ইস্তেগফার
আরবি: لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
উচ্চারণ: লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নী কুনতু মিনাজ্জালিমীন।
অর্থ: আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; আপনি পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা আম্বিয়া: ৮৭)
মাহাত্ম্য: নবী (স.) বলেছেন, ‘যে মুসলিম কোনো বিষয়ে এই দোয়া পাঠ করবে, আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দেবেন।’ (তিরমিজি: ৩৫০৫; হাকিম)
৭. রাসুল (স.)-এর বহুল পঠিত ইস্তেগফার
আরবি: رَبِّ اغْفِرْ لِي وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الْغَفُورُ
উচ্চারণ: রাব্বিগ্ফির লী ওয়া তুব্ ‘আলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত্ তাওয়্বাবুল গাফুর।
অর্থ: হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি তাওবা কবুলকারী, ক্ষমাশীল
মাহাত্ম্য: নবী (স.) এক বৈঠকে এটি প্রায় ১০০ বার পাঠ করতেন। (মেশকাত: ২৩৫২)
আরও পড়ুন: ইস্তেগফার কীভাবে করতে হয়?
বিশেষ ইস্তেগফার সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার: ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ দোয়া
আরবি: اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لاَ إِلٰهَ إِلاَّ أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلٰى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّه“ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা আনতা রব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাকতানি ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়াদিকা মাসতাতাতু, আউজুবিকা মিন শাররি মা সানাতু। আবু-উ লাকা বিনিমাতিকা আলাইয়া ওয়া আবু-উ লাকা বিজাম্বি ফাগফিরলী ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।’
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক, তুমি ছাড়া কোনো প্রভু নাই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমার বান্দা। আমি সাধ্যমত তোমার কাছে দেয়া ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতিগুলো পালনে সচেষ্ট আছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই। আমাকে যে নেয়ামত দান করেছ, তা স্বীকার করছি এবং আমি আমার পাপগুলো স্বীকার করছি। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কেননা তুমি ছাড়া কেউ ক্ষমাকারী নেই।’ (সহিহ বুখারি: ৬৩০৬)
মাহাত্ম্য: নবী (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দিনের বেলায় দোয়াটি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে পড়বে, অতঃপর সেদিন সন্ধ্যা হওয়ার আগেই মারা যাবে, সে জান্নাতিদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে এটি পড়বে, অতঃপর সকাল হওয়ার আগেই মারা যাবে, সে জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সহিহ বুখারি: ৬৩০৬)
ইস্তেগফারের অনন্য ফজিলতসমূহ
১. গুনাহ মোচন ও আত্মার পরিশুদ্ধি
২. দুশ্চিন্তা ও বিপদ থেকে মুক্তি
৩. রিজিক বৃদ্ধি ও বরকত (সূরা নূহ: ১০–১২)
৪. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন
৫. জান্নাতের প্রতিশ্রুতি ও পরকালে মুক্তি (ইবনে মাজাহ: ৩৮১৮)
ইস্তেগফারের শ্রেষ্ঠ সময়
- ফরজ নামাজের পর (সহিহ মুসলিম: ৫৯১)
- সাহরির সময় বা শেষ রাতে (সুরা আলে ইমরান: ১৭)
- কোনো গুনাহ বা ভুলের পরপরই (সুরা নিসা: ১৭)
- প্রতিদিন সকালে ও রাতে অন্তত একবার
আমল করার সহজ পদ্ধতি
- প্রতিদিন সকালে ও রাতে অন্তত ৩টি ইস্তেগফার পড়া শুরু করুন।
- নামাজ শেষে একবার ‘সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার’ পড়ুন।
- বিপদে পড়লে নবী ইউনুস (আ.)-এর দোয়া পাঠ করুন।
ক্ষমা চাওয়ায় লুকিয়ে আছে সফলতার রহস্য। ইস্তেগফার কেবল পাপ মোচনের দোয়া নয়, এটি জীবন বদলে দেওয়ার এক অলৌকিক শক্তি। নবী (স.) বলেছেন- ‘সেই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যার আমলনামায় প্রচুর ইস্তেগফার পাওয়া যাবে।’ (ইবনে মাজাহ: ৩৮১৮)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রতিদিন ইস্তেগফারের তাওফিক দিন। যাতে আমাদের অন্তর পরিষ্কার হয়, দুশ্চিন্তা দূর হয়, রিজিক বাড়ে এবং আমরা জান্নাতের অধিবাসী হতে পারি। আমিন।

