কেয়ামতের দিন একশ্রেণির মানুষকে পিঁপড়ার ন্যায় ক্ষুদ্রাকারে পুনরুত্থিত করা হবে। তাদেরকে ঘিরে থাকবে অপমাণ ও লাঞ্ছনা। অতঃপর তাদেরকে জাহান্নামের ‘বুলাস’ নামক এক ভয়াবহ কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে—যা শুধু আগুনের শাস্তির জন্য নয়, বরং তা চরম অবমাননা ও তাচ্ছিল্যেরও কেন্দ্রস্থল।
কেয়ামতের দিন ‘বুলাস’ কারাগারে কারা যাবে?
কোরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট বর্ণনা অনুযায়ী, এই কঠিন শাস্তির শিকার হবে অহংকারীরা। সেই অভিশপ্ত গুণের কারণে, যার ফলে ইবলিস এক সময়ের ইবাদতকারী থেকে চিরস্থায়ী অভিশাপে নিপতিত হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘অহংকারী ব্যক্তিরা কেয়ামতের দিন উঠবে মানুষের রূপে পিঁপড়াসদৃশ অবস্থায়। চারদিক থেকে লাঞ্ছনা তাদের বেষ্টন করে রাখবে। অতঃপর তাদের ‘বুলাস’ নামক জাহান্নামের এক কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যেখানে লেলিহান অগ্নি তাদের ঢেকে ফেলবে। সেখানে তারা জাহান্নামিদের গলিত পুঁজ-রক্ত ‘ত্বিনাতুল খাবাল’ পান করানো হবে।’ (তিরমিজি: ২৪৯২)
অহংকার বলতে কী বুঝানো হয়
অহংকার মানে মানুষকে অবজ্ঞা করা, হেয় মনে করা এবং সত্যকে অস্বীকার করা। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘যার অন্তরে তিল পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন- ‘মানুষ তো চায় তার পোশাক ও জুতা সুন্দর হোক, এটাও কি অহংকার?’ তিনি বললেন- ‘আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। তবে অহংকার হলো সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।’ (মুসলিম: ৯১)
বিজ্ঞাপন
অহংকার আল্লাহর চাঁদর
মানুষের অহংকার করার অধিকার নেই। মূলত অহংকার শুধু একজনই করতে পারেন। তিনি হলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ইজ্জত-সম্মান হচ্ছে আমারই পোশাক এবং গর্ব-অহংকার হচ্ছে আমারই চাদর। তাই যে ব্যক্তি এ দুয়ের কোনোটি নিয়ে টানাটানি করবে, তাকে আমি কঠোর শাস্তি দেবো। (রিয়াজুস সালেহিন: ৬২৩; মুসলিম: ২৬২০; আবু দাউদ: ৪০৯০, ইবনু মাজাহ: ৪১৭৪, আহমদ: ৭৩৩৫)
অহংকারীর স্থান জাহান্নাম
অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে কেয়ামতের দিন তুমি তাদের মুখগুলো কালো দেখতে পাবে. অহংকারীদের আবাসস্থল কি জাহান্নামে নয়? (সুরা যুমার: ৬০) তাদেরকে ‘বলা হবে- জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ করো, তোমাদেরকে চিরকাল এখানে থাকতে হবে। অহংকারীদের আবাসস্থল কতই না নিকৃষ্ট!’ (সুরা যুমার: ৭২)
মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তিল পরিমাণ অহংকার যার অন্তরে আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না...।’ (জামে তিরমিজি: ১৯৯৮)
অহংকারীদের সঙ্গে আল্লাহ কথা বলবেন না
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা অহংকারী ও দাম্ভিকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না, তাকে গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির সঙ্গে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কথা বলবেন না, তাদের গুনাহ থেকেও পবিত্র করবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতেও তাকাবেন না এবং তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। তারা হচ্ছে বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যুক রাষ্ট্রপতি ও দাম্ভিক ফকির।’ (মুসলিম: ১০৭)
আরও পড়ুন: ১৪ পাপের শাস্তি দুনিয়ায় দেওয়া হয়
অহংকারীদের ওপর আল্লাহর কঠিন রাগ
অহংকার এত বড় অপরাধ যে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বিচারকার্য শুরু করার আগে রাগান্বিত অবস্থায় ঘোষণা করবেন ‘আইনাল মুতাকাববিরুন’ অর্থাৎ দুনিয়াতে যারা অহংকার করে চলতো তারা কোথায়? এরপর তিনি অহংকারীদের পাকড়াও করার নির্দেশ দেবেন। তখন ফেরেশতারা তাদের পাকড়াও করবেন। আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আকাশমণ্ডলী গুটিয়ে নেবেন অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীকে ডান হাতে ধরে বললেন, আমিই বাদশাহ। কোথায় জবরদস্ত লোকেরা, কোথায় অহংকারীরা? এরপর তিনি বাম হাতে সমস্ত জমিন গুটিয়ে নেবেন এবং বললেন, আমিই বাদশাহ। কোথায় জবরদস্ত লোকেরা, কোথায় অহংকারীরা? (সহিহ মুসলিম: ৭২২৮-৬৯৪৪)
দুনিয়ায় অহংকারের শাস্তি
কেউ পছন্দ করে না অহংকারীদের। হয়ত সে তাৎক্ষণিক টের পায় না। এক আরবি গল্পে এর উপমা খুব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কেউ যখন নিচে তাকায়, তখন সবকিছুই তার কাছে ছোট ছোট মনে হয়। নিজের দুই চোখ দিয়ে হাজারো মানুষকে সে ছোট করে দেখে। কিন্তু যারা নিচে আছে তারাও তাকে ছোটই দেখে। অর্থাৎ অহংকারী যখন সবাইকে তুচ্ছ মনে করে তখন সেই অহংকারীকেও অন্য সবাই তুচ্ছ মনে করে। একবার বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি গর্ব করলে আল্লাহ তাআলা তাকে কঠিন শাস্তি দেন। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগেও এমন একটি ঘটনা ঘটে।
‘একদা এক ব্যক্তি এক জোড়া জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে (রাস্তা দিয়ে) চলছিল। তা নিয়ে খুব গর্ব বোধ হচ্ছিল তার। তার জমকালো লম্বা চুলগুলো সে খুব যত্নসহকারে আঁচড়ে রেখেছিল। হঠাৎ আল্লাহ তাআলা তাকে ভূমিতে ধসিয়ে দেন এবং সে কেয়ামত পর্যন্ত এভাবেই নিচের দিকে নামতে থাকবে।’ (বুখারি: ৫৭৮৯)
সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘একজন মানুষ সর্বদা অহংকার করতে থাকে, অতঃপর একটি সময় আসে, তার নাম জাব্বারিনদের (অহংকারী জালেম) খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। তখন তাকে এমন আজাব গ্রাস করে, যা অহংকারীদের গ্রাস করেছিল’। (তিরমিজি: ২০০০, হাদিসটি হাসান)
আরও পড়ুন: শিরক না করলে যেসব প্রতিদান পাবেন
যেসব কারণে মানুষ অহংকারী হয়
১. জ্ঞানের স্বল্পতা ২. পারিবারিক শিক্ষার অভাব ৩. পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার ৪. হিংসুটে মানসিকতা ৫. ধন- সম্পদ আধিক্য ৬. লোক দেখানো আমল ও ইবাদত ইত্যাদি
নিজের মধ্যে অহংকার আছে কি না যাচাই করুন
১. নিজেকে শ্রেষ্ঠ এবং অন্যকে তুচ্ছ ভাবার বদভ্যাস থাকলে বুঝে নেবেন আপনি নিশ্চিত অহংকারী। ঠিক এই দোষেই অভিশপ্ত হয়েছিল ইবলিস।
২. সত্যকে অস্বীকার করা। নমরুদ, আবু জাহেল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা, আরও অসংখ্য দাম্ভিক সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল।
৩. হাঁটাচলায় বড়ত্ব প্রকাশ করা।
৪. অর্থ-সম্পদ ও সৌন্দর্যের কারণে অন্যের প্রতি অন্তরে তুচ্ছভাব উদ্রেক হওয়া।
৫. দরিদ্র মানুষ ও অধীনস্থদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা।
৬. ভুল স্বীকার না করা এবং নিজের ভুল অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া।
৭. নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবা অহংকারের বড় আলামত।
অহংকার দূর করার উপায়
১. নিজের সৃষ্টি ও অস্তিত্ব নিয়ে ভাবা ২. মৃত্যুর কথা সর্বদা স্মরণ করা ৩. পরকালে জবাবদিহিতার ভয়ে ভীত থাকা ৪. আমার প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহ্ দেখেন এই ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা ৫. গরিব ও এতিমের সহযোগিতা করা ৬. অসুস্থকে সেবা প্রদান অথবা সেবা প্রদানে সহযোগিতা করা ৭. দম্ভভরে পৃথিবীতে পদচারণা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা ৮. গোপন ও রিয়ামুক্ত আমলে নিজেকে অভ্যস্ত করা ৯. আল্লাহর ভয়ে গোপনে ক্রন্দন করা, ১০. অন্যের সাথে নম্র আচরণ করা ১১. অন্যের ভুল ক্ষমা করে দেওয়া ১২. অহংকার বশত অন্যের সাথে অসদাচরণ করে ফেললে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ১৩. ভুলক্রমে অহংকার প্রকাশ পেলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ১৪. অহংকার থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া ১৫. অগ্রগামী হয়ে অন্যের আগেই সালাম দেওয়া ১৬. অহংকারীর পোশাক ও চাল চলন পরিহার করা। ১৭. আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা করা।
অহংকার পরিত্যাগ করার প্রতিদান জান্নাত
অহংকার পরিত্যাগ করার বিনিময়ে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি আছে। আল্লাহ বলেন, ‘এই হচ্ছে আখেরাতের নিবাস, যা আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা জমিনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকিদের জন্য।’ (সুরা কাসাস: ৮৩)
সারকথা, অহংকার মানব চরিত্রের এক ভয়ংকর ব্যাধি। এটি মানুষকে ধ্বংস করে দেয়, দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে অপমানজনক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। আসুন আমরা কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী জীবন গঠনে সচেষ্ট হই এবং অহংকারের এই ব্যাধি থেকে নিজেকে ও সমাজকে রক্ষা করি।

