শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

১৪ পাপের শাস্তি ‍দুনিয়ায় দেওয়া হয়

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০১:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

১৪ পাপের শাস্তি ‍দুনিয়ায় দেওয়া হয়

বান্দার সীমালঙ্ঘনের কারণে আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতেও নানা ধরনের শাস্তি দিয়ে থাকেন। পবিত্র কোরআনে মহা আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের ওপর যে বিপদই উপনীত হয় তা তোমাদের হাতের কামাই, তিনি অনেক অপরাধই ক্ষমা করে দেন’ (সুরা শুরা: ৩০)। ‘গুরুতর শাস্তির আগে আমি তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব যাতে তারা (অনুশোচনা নিয়ে) ফিরে আসে।’ (সুরা সাজদাহ: ২১)

নিচে ১৪টি জঘন্য পাপের পরিচয় তুলে ধরা হলো, যেগুলোর শাস্তি পরকালের জন্য নির্ধারিত রয়েছেই, দুনিয়াতেও পেতে হবে।


বিজ্ঞাপন


১. মা-বাবার অবাধ্যতা
সন্তানের জন্য দুনিয়াতে জান্নাত এবং জাহান্নাম হচ্ছেন মা-বাবা। মা-বাবা অমুসলিম হলেও সন্তানের ওপর তাদের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহর অবাধ্যতার বিষয় না থাকলে তাদের নির্দেশ মান্য করা চলা কর্তব্য। মা-বাবা অসন্তুষ্ট হলে মহান আল্লাহও অসন্তুষ্ট হয়ে যান। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, মা-বাবার সন্তুষ্টির মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর মা-বাবার অসন্তুষ্টির মধ্যে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি: ১৮৯৯)

অবাধ্য সন্তানকে মা-বাবা বদদোয়া বা অভিশাপ দিলে তা প্রতিফলিত হবেই। আনাস (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তিনটি দোয়া কখনো নামঞ্জুর করা হয় না: মাতা-পিতার দোয়া তার সন্তানের জন্য, রোজাদারের দোয়া ও মুসাফিরের দোয়া। (সহিহুল জামে: ৩/৬৩)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক! ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক! ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক! জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন ব্যক্তি ইয়া রাসুলুল্লাহ? উত্তরে নবীজি বললেন, যে তার বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পেল অথবা তাদের একজনকে পেল কিন্তু তাদের খেদমত করে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না।’ (মুসলিম: ২/৩১৪)

আরও পড়ুন: মৃত মা-বাবার জন্য সন্তানের করণীয়


বিজ্ঞাপন


২. জুলুম
জুলুম কঠিন গুনাহ। দুনিয়া-আখেরাত কোথাও জালেমকে ছাড় দেওয়া হয় না। আজ হোক বা কাল—তাকে শাস্তি পেতেই হবে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি তাদেরকে অবকাশ দিয়ে রাখি। আমার কৌশল অতি শক্তিশালী।’(সূরা নুন: ৪৫) আল্লাহ পাক আরও বলেন, ‘জালেমরা যা করছে, সে সম্পর্কে তোমরা আল্লাহকে উদাসীন ভেবো না, তিনি তাদের ছাড় দিয়ে যাচ্ছেন ওই দিন পর্যন্ত, যেদিন চোখগুলো সব আতঙ্কে বড় বড় হয়ে যাবে।’(সুরা ইবরাহীম: ৪৩) অন্য আয়াতে তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, এমনই ছিল তোমার রবের ধরপাকড়, যখন তিনি ধরেছিলেন ওই জালেম বসতিগুলোকে, নিশ্চয়ই তার ধরা অনেক কঠিন যন্ত্রণাময়। (সুরা হুদ: ১০২)

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখেরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’(তিরমিজি: ২৫১১) সীমালঙ্ঘনের অপরাধে আল্লাহ ফেরাউনকে নীল নদের পানিতে ডুবিয়ে মেরেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তাদের সবাইকেই আমি (তাদের) নিজ নিজ পাপের কারণে পাকড়াও করেছি, তাদের কারো ওপর প্রচণ্ড ঝড় পাঠিয়েছি, কাউকে মহাগর্জন এসে আঘাত হেনেছে, কাউকে আমি জমিনের নিচে গেড়ে দিয়েছি, আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি’। (সুরা আনকাবুত :৪০)

আরও পড়ুন: জুলুম অনেক বড় গুনাহ

৩. কোনো মুসলমানের ইজ্জত নষ্ট করা
মানুষের সম্মান রক্ষা করা ইসলামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এর ফজিলত অসীম। জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার বড় উপায়। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, ‘যে তার ভাইয়ের সম্মান তার অনুপস্থিতিতে রক্ষা করে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার মুখমণ্ডল আগুন থেকে রক্ষা করবেন।’ (সুনানে তিরমিজি: ১৯৩১)
অন্যদিকে মানুষের সম্মানহানি করলে এর শাস্তি শুধু আখেরাতে নয়, ‍দুনিয়াতেও পেতে হয়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) মিম্বারে উঠে চিত্কার দিয়ে বললেন, হে লোকেরা, যারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছ, কিন্তু অন্তরে এখনো ঈমান দৃঢ় হয়নি! তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দেবে না, তাদের লজ্জা দেবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না। কেননা যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়, আল্লাহ তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তির দোষ আল্লাহ প্রকাশ করে দেবেন, তাকে অপমান করে ছাড়বেন, সে তার উটের হাওদার ভেতরে অবস্থান করে থাকলেও। (সুনানে তিরমিজি: ২০৩২)

মানুষের ইজ্জত-সম্মান নিয়ে খেলা করা অনেকে ছোটখাটো বিষয় মনে করেন। অথচ এটি গুরুতর অপরাধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তোমরা মুখে মুখে তা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে, যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং তোমরা তাকে তুচ্ছ গণ্য করছিলে, যদিও আল্লাহর কাছে তা ছিল গুরুতর বিষয়।’ (সুরা নুর: ১৫)

৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা
ইসলামি শরিয়তে সাধ্যানুযায়ী আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ওয়াজিব। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (সহিহ বুখারি: ৬১৩৮)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখেরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’ (তিরমিজি: ২৫১১)

আরও পড়ুন: আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরতে গেলে যে সওয়াব

৫. লোক দেখানো আমল
রিয়া বা লোক দেখানো আমলকে বলা হয় ছোট শিরক। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—‘আমি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, তা হলো শিরকে আসগর (ছোট শিরক)। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শিরকে আসগর কী? তিনি বলেন, রিয়া বা লোক দেখানো আমল। কেয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে তাদের কাছে যাও, দেখো তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’ (আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/৪২৮-৪২৯; হাইসামি, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১/১০২। হাদিসের মান- সহিহ)

লোক দেখানো আমল মুনাফিকের অন্যতম আলামত। এর পরিণতি ভয়াবহ। জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে শোনানোর জন্য এবং মানুষের নিকট প্রসিদ্ধি লাভ করার জন্য কোনো আমল করে— আল্লাহ তাআলা তার অবস্থা মানুষকে শুনিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করে, আল্লাহ তাআলা তাকে রিয়াকারীর শাস্তি দেবেন। (বুখারি: ২/৯৬২; মুসলিম: ২/৪১২; তিরমিজি: ২/৬১; ইবনে মাজাহ: ২/৩১০; মুসনাদে আহমদ: ৩/৪০; শুয়াবুল ঈমান: ৫/৩৩০)

ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেন, লোক দেখানো ইবাদতের মাধ্যমে নিজের মহত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই হলো রিয়া। জেনে রেখো, রিয়া হারাম আর রিয়াকারী আল্লাহ তাআলার কাছে অভিশপ্ত। (তাসকিলে কিরদার, উর্দু, পৃষ্ঠা-১৭৬)

আরও পড়ুন: ‘নেক আমল’ যে কারণে গোপন রাখতেন পূর্বসূরিরা

৬. আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করা
আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করলে বা আল্লাহর নেয়ামতের না-শোকরি করলে আল্লাহ তাআলা নগদে শাস্তি দেন। সুরা নাহালে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহ উপমা পেশ করছেন, একটি জনপদ, যা ছিল নিরাপদ ও শান্ত। সবদিক থেকে তার রিজিক তাতে বিপুলভাবে আসত। অতঃপর সে আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করল। তখন তারা যা করত তার কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষুধা ও ভয়ের পোশাক পরালেন।’ (সুরা নাহাল: ১১২)

তাই আমাদের উচিত হবে-সবসময় আল্লাহর নেয়ামতের শোকর করা। এতে আল্লাহ তাআলা নেয়ামত বাড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গিকার করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয়ই আমার আজাব বড় কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম: ৭)

৭. ব্যভিচার
জেনা বা নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে ইসলাম। ব্যভিচারের শাস্তি দুনিয়াতেও হয়ে থাকে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায় আর তিনটি আখেরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলো—১. চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া, ২. দরিদ্র, ৩. অকালমৃত্যু । আর আখিরাতের তিনটি হলো—১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি, ২. হিসাব-নিকাশের কঠোরতা ও ৩. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। (ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ই.ফা. পৃ-১০৯)

ব্যভিচারে অভ্যস্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে ঈমান ও আমল থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘কোনো মানুষ যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন তার ভেতর থেকে ঈমান বেরিয়ে যায় এবং এটি তার মাথার ওপর মেঘখণ্ডের মতো ভাসতে থাকে। অতঃপর সে যখন তাওবা করে, তখন ঈমান আবার তার কাছে ফিরে আসে।’ (আবু দাউদ: ৪৬৯০)

আরও পড়ুন: পরকীয়ার শাস্তি 

৮. অহংকার
অহংকারীরা পরকালে কঠিন শাস্তি পাবে। জান্নাত তার জন্য হারাম। অহংকারের শাস্তি ‍দুনিয়াতেও দেওয়া হয়। একবার বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি গর্ব করলে আল্লাহ তাআলা তাকে কঠিন শাস্তি দেন। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগেও এমন একটি ঘটনা ঘটে।

‘একদা এক ব্যক্তি এক জোড়া জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে (রাস্তা দিয়ে) চলছিল। তা নিয়ে খুব গর্ব বোধ হচ্ছিল তার। তার জমকালো লম্বা চুলগুলো সে খুব যত্নসহকারে আঁচড়ে রেখেছিল। হঠাৎ আল্লাহ তাআলা তাকে ভূমিতে ধসিয়ে দেন এবং সে কেয়ামত পর্যন্ত এভাবেই নিচের দিকে নামতে থাকবে।’ (বুখারি: ৫৭৮৯)

সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘একজন মানুষ সর্বদা অহংকার করতে থাকে, অতঃপর একটি সময় আসে, তার নাম জাব্বারিনদের (অহংকারী জালেম) খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। তখন তাকে এমন আজাব গ্রাস করে, যা অহংকারীদের গ্রাস করেছিল’। (তিরমিজি: ২০০০, হাদিসটি হাসান)

অহংকারীর পরিণাম সম্পর্কে আরেক হাদিসে এসেছে, ‘একদিন এক লোক রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে বাম হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করলে আল্লাহর রাসুল (স.) তাকে বললেন, তুমি ডান হাত দিয়ে খাও। উত্তরে লোকটি বলল, আমি পারছি না। তার কথার প্রেক্ষাপটে রাসুলুল্লাহ (স.) তাকে প্রশ্ন করলেন—তুমি পারবে না? মূলত রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কথা অমান্য করতে তাকে অহংকারই বিরত রাখে। বর্ণনাকারী বলেন, লোকটি আর কখনোই তার হাতকে তার মুখ পর্যন্ত ওঠাতে পারেনি। (সহিহ মুসলিম: ২০২১)

আরও পড়ুন: আপনি কি অহংকারী? যেভাবে বুঝবেন

৯. সুদখোর ও ঘুষখোর
সুদের সঙ্গে জড়িত সবাইকে নবীজি (স.) অভিশাপ দিয়েছেন। যাদের ওপর নবীজি লানত দিয়েছেন তারা দুনিয়াতেই শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। বর্ণিত হয়েছে, ‘যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, যে সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয় সবার প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.) লানত করেছেন।’ (তিরমিজি: ১২০৬)
সুদের মাধ্যমে যত অর্থই উপার্জন করুক, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাতে কোনো বরকত নেই। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করে দেন এবং সদকাকে বর্ধিত করে দেন।’ (সুরা বাকারা: ২৭৬) 

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদরা বলেন, যে সম্পদের সঙ্গে সুদ মিশ্রিত হয়ে যায়, বেশির ভাগ সময় সেগুলো ধ্বংস হয়, অধিকন্তু আগে যা ছিল, তা-ও নিঃশেষ হয়ে যায়। 

ঘুষও হারাম উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত। ঘুষের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকারীদের ব্যাপারে রাসুল (স.) বলেছেন, ঘুষদাতা ও গ্রহীতার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। (ইবনে মাজাহ: ২৩১৩)

আরও পড়ুন: সুদ খাওয়ার শাস্তি কী?

১০. মদপান ও জুয়াখেলা
মদপান ও জুয়া খেলা উভয় শয়তানের কাজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, তাহলেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে। (সুরা আল মায়েদা: ৯০)

প্রাচীনকাল থেকে মাদকাসক্তির কারণে ইতিহাসের বহু কীর্তিমান জাতি বিপর্যস্ত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহকে সেই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহ তাআলা মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ করেছেন। সেই নিষেধ অমান্য করলে নিশ্চয়ই দুনিয়াতেই শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত হতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ ও মানুষের জন্য উপকার। কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা  বেশি।’ (সুরা বাকারা: ২১৯)

আমরা জানি যে, মদ ও জুয়ার কারণে সমাজে সম্পর্কের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করে। বিদ্বেষ হানাহানি লেগে থাকে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘শয়তান তো এটা চায় যে মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হোক এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমরা বিরত থাকো। সুতরাং এখনো কি তোমরা এগুলো থেকে বিরত থাকবে না?’ (সুরা মায়েদা: ৯১)

১১. চুরি ডাকাতি ছিনতাই
চুরি করা জঘন্য অপরাধ। এর শাস্তি হলো, কবজি পর্যন্ত হাত কেটে দেওয়া। যেমন আল্লাহর বাণী—‘পুরুষ চোর ও নারী চোরের অপরাধের শাস্তিস্বরূপ উভয়ের হাত কবজি পর্যন্ত কেটে দাও।’ (সুরা : মায়েদা: ৩৮) ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট ইত্যাদি চুরি অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ। কারণ চুরি হয় গোপনে। আর ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাট হয় প্রকাশ্যে। এদের শাস্তি হলো হত্যা, শূলে চড়ানো, হাত-পা কেটে ফেলা ও দেশ থেকে বহিষ্কার করা। মহানবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে লুটপাট করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ, মেশকাত, পৃ-৩১৩)

ডাকাতি, ছিনতাই করার সময় ঈমান থাকে না। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘জেনাকারী যখন জেনায় লিপ্ত হয়, তখন সে মুমিন থাকে না। যখন কেউ মদপান করে, তখন সে মুমিন থাকে না। কেউ চুরি করার সময় মুমিন থাকে না এবং কোনো ছিনতাইকারী এমনভাবে ছিনতাই করে যে, ভুক্তভোগী তার দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকে; তখন সে (ছিনতাইকারী) মুমিন থাকে না। (সহিহ বুখারি: ৬৭৭২)

সবরকম হারাম উপার্জনে বাহ্যিকভাবে প্রাচুর্য দেখা গেলেও মূলত তা মানুষের জীবন থেকে বরকত তুলে নেয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল ও বৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করে, তাকে বরকত দান করা হয়। আর যে ব্যক্তি হারাম ও অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করে, সে এমন ব্যক্তির মতো—আহার করেও তৃপ্ত হয় না (অর্থাৎ সে যতই ভক্ষণ করুক না কেন; তার ক্ষুধা নিবারণ হয় না)।’ (মুসলিম: ১০৫২) 

১২. মিথ্যা কসম ও ধোঁকা
মিথ্যা কসম খাওয়া এবং মানুষকে ধোঁকা দিলে তাকে নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন করা হয়। এর একটি হলো- আয়-উপার্জনের বরকত চলে যায়। আর বরকত চলে যাওয়া মানে রিজিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘বেচাকেনা করার সময় তোমরা অধিক কসম করা থেকে সাবধান থেকো। কারণ, মিথ্যা কসমের দ্বারা বিক্রি বেশি হয়, কিন্তু বরকত ধ্বংস হয়ে যায়।’ (মুসলিম: ১,৬০৭)

রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেছেন, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতা যতক্ষণ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা কিংবা বাতিল করার সুযোগ রয়েছে। যদি তারা সত্য বলে এবং পণ্যের প্রকৃত অবস্থা ব্যক্ত করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং পণ্যের দোষ গোপন করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (বুখারি: ২০৭৯)

১৩. জাকাত না দেওয়া 
জাকাত ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ বা মৌলিক বিধান। জাকাতের বিধান প্রণয়ন করে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ভারসাম্য ঠিক রেখেছে ইসলাম। সঠিকভাবে জাকাতের বিধান আদায় না করলে রিজিকের বরকত উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং এতে রিজিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন কোনো জাতি জাকাত আদায় করা বন্ধ করে দেয়; আসমান থেকে তখন বৃষ্টিবর্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পৃথিবীর বুকে যদি কোনো চতুষ্পদ জন্তু না থাকত, তাহলে আর কখনো বৃষ্টি হতো না।’ (ইবনে মাজাহ: ৪,০১৯)

১৪. হিংসা
হিংসা এমন এক ব্যাধি, যা শুধু মনের নয়, দেহেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বলা হয়ে থাকে যে, হিংসুক মানুষের কোনো বিশ্রাম (ঘুম) নেই ও সে বন্ধুর লেবাসে একজন শত্রু । হিংসা হিংসুককেই প্রথমে হত্যা করে। আল্লাহ তাআলা তাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘..বলে দাও, তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মরো..।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১৯)

একজন ইমানদারের জন্য নিজেকে হিংসামুক্ত রাখা যেমন জরুরি, তেমনি সর্বদা হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করাও জরুরি। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, 'আর (তুমি বলো, আমি আশ্রয় চাই) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।' (সুরা ফালাক: ৫)

কোরআন-হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, উল্লেখিত গুনাহগুলোর কারণে বান্দা যেকোনো সময় যেকোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উল্লেখিত গুনাহগুলো থেকে সাবধান হওয়ার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সব আদেশ-নিষেধ মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর