ইসলামে স্বাস্থ্য সুরক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম।’ (সহিহ মুসলিম: ২৬৬৪)। নবী করিম (স.) সাহাবিদের দ্রুত চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করেছেন এবং তিনি নিজেও অসুস্থতার সময় চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার নিরাময়ের উপকরণ তিনি সৃষ্টি করেননি।’ (বুখারি: ৫৬৭৮) অথচ বাংলাদেশে ৬৩% নারী প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগলেও মাত্র ২৮% বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন: ২০২৪)
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ
ইসলামে স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে ঈমানের অঙ্গ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। প্রখ্যাত ইসলামি ফিকহ বিশেষজ্ঞ ইমাম ইবনে কাইয়িম (রহ.) তাঁর ‘তিব্বুন নববী’ গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, ‘চিকিৎসা গ্রহণ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান, বিশেষ করে যখন জীবন বা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থাকে।’ (পৃষ্ঠা ১২৩)।
ফিকহুল ইসলামীর ৪র্থ খণ্ডে উল্লেখ আছে, জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসার ক্ষেত্রে লজ্জা ত্যাগ করা ওয়াজিব। অর্থাৎ, প্রাণঘাতী ঝুঁকির ক্ষেত্রে পুরুষ চিকিৎসকের কাছেও চিকিৎসা নেওয়া যাবে, যদি নারী চিকিৎসক পাওয়া না যায়।
তবে, নারী ডাক্তার থাকলে বা নারী ডাক্তারের চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ থাকলে নারীরা নারী ডাক্তারের চিকিৎসা নেবে। শুধুমাত্র রোগের বিশেষজ্ঞ নারী ডাক্তার পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে পুরুষ ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে পারবে। সেখানে নারীর কোনো অভিভাবক তার সঙ্গে থাকবে। (আল বাহরুর রায়েক: ৮/১৯২)
বিজ্ঞাপন
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশ নারী স্বাস্থ্য সমিতির ২০২৩ সালের জরিপ অনুসারে, ৫৮% পরিবারের পুরুষ সদস্য নারীদের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক। এদের মধ্যে ২৩% শুধুমাত্র মহিলা ডাক্তার দেখাতে রাজি। অন্যদিকে ৪২% নারী লজ্জার কারণে সমস্যা গোপন রাখেন। গ্রামাঞ্চলে ৭২% পরিবার পুরুষ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে অস্বীকার করে।

স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারী স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা উদ্বেগজনক। প্রতি ১০,০০০ নারীর জন্য মাত্র ০.৭ জন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত অনুপাতের চেয়ে অনেক কম। দেশের ৬০% উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো নারী বিশেষজ্ঞ নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
টেলিমেডিসিন সেবার প্রসারও সীমিত। বর্তমানে এই সেবা মাত্র ৩০% এলাকায় পৌঁছেছে, অথচ প্রতিদিন হাজারো নারী টেলিমেডিসিন সেবার জন্য কল করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী স্বাস্থ্যসেবার এই ঘাটতি দূর করতে প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একজন নারী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং টেলিমেডিসিন সেবার সম্প্রসারণ জরুরি।
আরও পড়ুন: সুস্বাস্থ্যের জন্য নবীজির ৬ উপদেশ
সমাধানের পথ
১. ধর্মীয় প্রচার বাড়াতে হবে
ইসলামিক ফাউন্ডেশন ‘নারী স্বাস্থ্য কাফেলা’ কর্মসূচির আওতায় মসজিদভিত্তিক সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সাপ্তাহিক স্বাস্থ্য সেমিনারের মাধ্যমে নারীদের চিকিৎসা গ্রহণে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানানো যেতে পারে।
২. পরিকাঠামো উন্নয়ন জরুরি
প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে ৫ জন নারী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, ৩৩৬৫ নম্বরে ২৪/৭ টেলিমেডিসিন সেবা চালু করে গ্রামীণ নারীদের জন্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ সহজলভ্য করতে হবে।
৩. সচেতনতা কার্যক্রম প্রসারিত করতে হবে
স্কুল ও মাদ্রাসায় স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে কিশোরী থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পায়। এ ছাড়া, ইমাম ও শিক্ষকদের মাধ্যমে সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে স্বাস্থ্য কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: ইসলামে চিকিৎসকের জবাবদিহিতা কঠিন
সফলতার উদাহরণ
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ইসলামিক মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর নারী স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের ফলে এলাকায় নারীদের চিকিৎসা সেবা গ্রহণের হার ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার ৩৫% কমেছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ১৫০ জন মহিলা চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে, যারা নারী স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
এ বিষয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফাতেমা বেগম বলেন, "মসজিদকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং ব্যবস্থা চালু করা গেলে আগামী পাঁচ বছরে নারী স্বাস্থ্য সচেতনতা দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে। আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাস্থ্য শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।"
শেষ কথা, রাসুল (স.) এর বাণী- ‘তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো, কারণ আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার নিরাময় নেই।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৮৫৫)। ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সমন্বয়ে নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
তথ্যসূত্র
১. বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন রিপোর্ট ২০২৪
২. ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফতোয়া নং ৪৫৬/২০২৩
৩. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৪
৪. হাটহাজারী ইসলামিক মেডিকেল কলেজের বার্ষিক প্রতিবেদন
৫. আল-বাহরুর রায়েক ৮/১৯২

