কোরবানির গোশত নিয়ে একটি সাধারণ প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খায় যে- গরিবরা কি কোরবানির প্রাপ্ত গোশত বিক্রি করতে পারে? ইসলামি শরিয়তের আলোকে এ বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। দলিল ও ফকিহদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী চলুন বিষয়টি বিশ্লেষণ করি।
কোরবানির গোশত বিক্রি করা প্রসঙ্গে ইসলামের অবস্থান
কোরবানির উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট পশু জবাই করা এবং এর গোশত নির্দিষ্ট নিয়মে বণ্টন করা। শরিয়তে মূলত দুই ধরনের মানুষকে গোশত দেওয়া হয়- ১. দান হিসেবে (সদকা) গরিব-মিসকিনদের ২. হাদিয়া (উপহার) হিসেবে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের
গরিব ব্যক্তি যখন কোরবানির গোশত পায়, সেটা মূলত সদকার মাল হিসেবে গ্রহণ করে। এখন প্রশ্ন হলো, সদকার মাল কি বিক্রি করা জায়েজ?
হানাফি মাজহাবের ফকিহদের মতে- وَإِذَا تَصَدَّقَ عَلَى الْفَقِيرِ بِشَيْءٍ مِنَ اللَّحْمِ مَلَكَهُ، فَيَجُوزُ لَهُ الْبَيْعُ وَغَيْرُهُ، لِأَنَّهُ تَمَلَّكَهُ بِالتَّصَدُّقِ ‘সদকার মাল যখন প্রাপক গ্রহণ করে, তখন সেটি তার ব্যক্তিগত মাল হয়ে যায়। সে চাইলে সেটা খেতে পারে, অন্যকে দিতে পারে, এমনকি বিক্রি করাও তার জন্য বৈধ।’ (ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ৫/৩০০; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২১১)
অর্থাৎ, কোরবানির গোশত গরিব ব্যক্তির হাতে পৌঁছানোর পর তা তার মালিকানায় চলে যায়। এরপর সে যেভাবে চায়, সেভাবে তা ব্যবহার করতে পারে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: কোরবানির গোশত বণ্টনে যে ভুল করা যাবে না
ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন- ‘যখন মিসকিন কোরবানির গোশত গ্রহণ করে, তা তার মাল হয়ে যায়। এরপর সে তা বিক্রি করলে কোনো গুনাহ হবে না।’ (আল-মাবসুত, সারাখসি: ১২/১২, আল-বাহরুর রায়েক: ৯/৫৪)
হাদিসে কোরবানির গোশত বিক্রিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেটি মূলত কোরবানিদাতা ও তার পরিবারের জন্য প্রযোজ্য। যাতে কোরবানিকে ব্যবসা বা লেনদেনের বস্তু বানানো না হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি কোরবানি করে, সে যেন গোশতের কোনো অংশ বিক্রি না করে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৩৫৭৫
বর্তমান বাস্তবতায় প্রয়োগ
সমাজে অনেক সময় গরিব ব্যক্তি কোরবানির দিনে একসাথে অনেক গোশত পায়, যা তার জন্য সংরক্ষণ বা খাওয়া সম্ভব হয় না। তখন অতিরিক্ত অংশ বিক্রি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করে—এটা তার জন্য বৈধ ও শরিয়তসম্মত।
তবে এই বিক্রি যেন তার দরিদ্রতার কারণেই হয়, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে না হয়। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বানানো হলেই সেটা হারাম হয়ে যাবে। গরিবদের প্রতি আলেমদের পরামর্শ হলো- ‘যতটা সম্ভব গোশত বিক্রি না করে অন্য উৎস থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই প্রয়োজনিয়তা পূরণের চেষ্টা করুন।’
আরও পড়ুন: কোরবানির গোশতে আত্মীয়দের হক কতটুকু, না দিলে গুনাহ হবে?
কোরবানিদাতাদের জন্য সতর্কতা
১. কোরবানিদাতা যেন গোশতের অংশ কাউকে দেয়ার সময় শর্ত না দেয় যে, ‘তুমি এটা খাবে, বিক্রি করবে না’—এটি অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ।
২. এমন লোকদের সদকা বা হাদিয়া দেওয়া উচিত, যারা কোরবানি করেনি বা সত্যিকার অর্থে দরিদ্র।
৩. কোরবানির চামড়া বা গোশত দিয়ে কসাইয়ের পারিশ্রমিক দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। তবে ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরকে গোশত খাওয়ানো যাবে।’ (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৪; আলবাহরুর রায়েক: ৮/৩২৬)
ইসলাম মূলত গরিবদের জন্য দয়ার দ্বার উন্মুক্ত রেখেছে, যাতে তারা নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ ব্যবহার করতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের ইসলামি প্রত্যেক অনুশাসন জানার ও মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

