ঈদুল আজহা মুসলমানদের জন্য আত্মত্যাগের অন্যতম বড় ইবাদত। এই ইবাদতের মূল রূপ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করা। কিন্তু শুধু পশু জবাই করলেই কোরবানির ইবাদত পূর্ণ হয় না; বরং কোরবানির গোশত বণ্টনও শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। এ বিষয়ে অবহেলা করলে ইবাদতের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইসলামি ফকিহদের মতে, শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী বণ্টন না করলে কোরবানি সওয়াবশূন্যও হতে পারে।
নিম্নে কোরবানির গোশত বণ্টনে কয়েকটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর ভুল ও সেগুলো থেকে বাঁচার উপায় তুলে ধরা হলো:
বিজ্ঞাপন
১. মান্নতের পশুর গোশত নিজে খাওয়া
যদি কেউ মান্নত আদায়ের উদ্দেশ্যে পশু জবাই করেন, তবে সেই গোশতের পুরোটাই গরিবদের মাঝে বিতরণ করা ওয়াজিব। মান্নতকারী নিজে বা তার পরিবার এই গোশত খেতে পারবে না। (ফতোয়ায়ে কাসিমিয়া, খণ্ড: ১৭, পৃ. ৮২–৮৩)
২. সামাজিকভাবে ধনী-গরিব সবাইকে গোশত বিতরণ
কিছু এলাকায় প্রচলিত আছে যে, কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অংশের মাংস নিয়ে তা মহল্লাব্যাপী বিতরণ করা হয়। এতে ধনী, গরিব, এমনকি কোরবানিদাতারাও অংশ পান, যা মান্নতের গোশতের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভুল এবং শরিয়তবিরোধী। তবে যদি এটি স্বেচ্ছায় হয় এবং কেবল গরিবদের মাঝেই বণ্টন হয়, তাহলে তা বৈধ। (দারুল উলুম দেওবন্দ ফতোয়া নং: ১৫৩৮৩১)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: যেভাবে কোরবানি করলে কবুল হয়
৩. শরিকে কোরবানিতে অসাম্য
একাধিক ব্যক্তি মিলে কোরবানি করলে প্রত্যেকের অংশ সমান হতে হবে এবং কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হওয়া যাবে না। কারও অংশ কম হলে কারও কোরবানি গ্রহণযোগ্য হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড: ৪, পৃ. ২০৭)
৪. ওজন না করে অনুমানভিত্তিক বণ্টন
কোরবানির গোশত, মাথা বা পা বণ্টনের ক্ষেত্রে অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নয়। বরং নির্ভুলভাবে ওজন করে সবার মধ্যে বণ্টন করতে হবে। (দুররুল মুখতার, খণ্ড: ৬, পৃ. ৩১৭; কাজিখান, খণ্ড: ৩, পৃ. ৩৫১)
৫. কসাইকে গোশত পারিশ্রমিক দেওয়া
কোরবানির গোশত, চামড়া বা কোনো অংশ কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া বৈধ নয়। বরং আলাদা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে নগদ প্রদান করতে হবে। (কিফায়াতুল মুফতি, খণ্ড: ৮, পৃ. ২৬৫)
আরও পড়ুন: কোরবানির চামড়ার আসল হকদার কে?
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা
আকিকার গোশত সবাই খেতে পারবে: আকিকার গোশত কোরবানির মতোই বণ্টনযোগ্য। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, ধনী-গরিব সবাই খেতে পারে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ৫/৩০৪; ইলাউস সুনান: ১৭/১১৮)
গোশত জমা করে রাখা যাবে: রাসুল (স.) বলেন, ‘তোমরা কোরবানির গোশত খাও, জমা রাখো এবং সদকা করো।’ (সহিহ মুসলিম: ১৯৭২; সহিহ বুখারি: ৫৫৬৯)
ধনী বা অমুসলিমকে উপহার দেওয়া বৈধ: কোরবানির মাংস ধনী বা অমুসলিম প্রতিবেশীকেও উপহার হিসেবে দেওয়া বৈধ। (ইলাউস সুনান: ৭/২৮৩; ফতোয়া হিন্দিয়া: ৫/৩০০; আদাবুল মুফরাদ: ১২৮)
গোশত, চর্বি, চামড়া বিক্রি করা নিষিদ্ধ: কোরবানির গোশত, চর্বি বা চামড়া বিক্রি করা নিষিদ্ধ। বিক্রি করলে পুরো মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (ইলাউস সুনান: ১৭/২৫৯; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৫; কাজিখান: ৩/৩৫৪; আলমগিরি: ৫/৩০১)
কোরবানির গোশত বণ্টন শুধু দয়ার কাজ নয়, এটি একপ্রকার ইবাদতও বটে। তাই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে সঠিক বণ্টনের মাধ্যমে ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলাই মুসলিমদের দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক নিয়মে কোরবানির গোশত বণ্টনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

