সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

নবীজিকে অবমাননা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩৯ এএম

শেয়ার করুন:

নবীজিকে অবমাননা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ

মহানবী (স.)-কে আল্লাহ তাআলা রাহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তিনি উম্মতের মুক্তির কাণ্ডারি। তাঁকে যারা অবমাননা করে তারা একদিকে গণ্ডমূর্খ, অন্যদিকে কঠিন শাস্তির যোগ্য। তাদের ওপর আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে লানত করেছেন। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে চরম অপমানজনক শাস্তি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের ওপর আল্লাহ লানত করেছেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন এমন শাস্তি, যা লাঞ্ছিত করে ছাড়বে।’ (সুরা আহজাব: ৫৭)

আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি তার সামনে হেদায়েত স্পষ্ট হওয়ার পরও রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করবে ও মুমিনের পথ ছাড়া অন্যকোনো পথ অনুসরণ করবে, আমি তাকে সে পথেই ছেড়ে দেব, যা সে অবলম্বন করেছে। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব, যা অতি মন্দ ঠিকানা। (সুরা নিসা: ১১৫)


বিজ্ঞাপন


রাসুলুল্লাহ (স.)-কে নিয়ে কটূক্তিকারী বা শাতেমে রাসুলের ব্যাপারে চার মাজহাবই একমত যে, সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে এবং তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু কটূক্তিকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে তার কাছে তাওবা চাওয়া হবে কি না এবং সে নিজ থেকে তাওবা করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে কি না সে ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

প্রসিদ্ধ চার মাজহাবের ফতোয়া
হানাফি মাজহাবের সকল আলেম একমত যে, কেউ রাসুলুল্লাহ (স.)-কে কটাক্ষ করলে কিংবা তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করলে অবশ্যই তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে ৷ হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ফতোয়ায়ে শামীতে উল্লেখ করা হয়েছে— قال ابو بكر بن المنذر اجمع عوام اهل العلم علي من سب النبي صلي الله عليه وسلم يقتل وممن قال ذالك مالك بن انس والليث واحمد واسحاق وهو مذهب الشافعي হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ আলেম আবু বকর ইবনে মুনজির (রহ) বলেন, ‘এ ব্যপারে সকল ওলামায়ে কেরাম একমত যে, যে ব্যক্তি নবী (স.)-কে কটাক্ষ করবে বা গালি দিবে তাকে হত্যা করতে হবে। ইমাম মালিক ইবনে আনাস, লাইস, আহমদ, ইসহাক ও ইমাম শাফেয়ি রাহিমাহুল্লাহও অনুরুপ মত ব্যক্ত করেছেন।’ (ফতোয়ায়ে শামি: ৪: ৪১৭ পৃষ্ঠা)

আরও পড়ুন: নবীজির অন্তিম মুহূর্তের মহামূল্যবান ১৪ উপদেশ

শাফেয়ি মাজহাবের ফতোয়া হলো- قال الخطابي لا اعلم احدا من المسلمين اختلف في وجوب قتله শাফেয়ি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফকিহ ইমাম খাত্তাবি (রহ.) বলেন, ‘নবী (স.)-এর গালিদাতাকে হত্যা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত আছে বলে আমার জানা নেই ৷’ (আস সারেমুল মাসলুল: ১:৯ পৃষ্ঠা)


বিজ্ঞাপন


মালেকি মাজহাবের ফতোয়া হলো- ومن سب الله او رسوله او غيره من الانبياء عليهم السلام قتل حدا ولا تسقطه التوبة ‘যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহ এবং তার রাসুল (স.)-কে কিংবা অন্য কোনো নবীকে গালি দেয় তবে ইসলামের বিধান অনুযায়ী তাকে হত্যা করা হবে। তওবার কারণে তার হত্যার বিধান রহিত হবে না৷ ( আজ জাখিরা ফি ফিকহিল মালেকি: ১১: ৩০ পৃষ্ঠা)

হাম্বলি মাজহাবের ফতোয়া হলো- وقد نص احد علي ذلك في مواضع متعددة قال حنبل سمعت ابا عبد الله يقول كل من شتم النبي صلي الله عليه وسلم او تنقصه مسلما كان او كافرا فعليه القتل واري ان يقتل ولا يستتاب ইমান আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) একাধিক স্থানে একথা ব্যক্ত করেছেন যে, যে ব্যক্তি নবী (স.)-কে গালি দেবে অথবা মানহানী করবে, তাকে অবশ্যই হত্যা করা হবে ৷ চাই সে মুসলিম হোক বা কাফের। আমি মনে করি, তাকে তাওবার সুযোগ না দিয়ে হত্যা করা হোক৷ ( আস সারেমুল মাসলুল ১:১০ পৃষ্ঠা)

আরও পড়ুন: নবীজির আদর্শ হোক জীবনের পাথেয়

বিশিষ্ট ফকিহদের বক্তব্য
হানাফি মাজহাবের ইমাম আবু ইউসুফ (রহ) বলেন-  وأيُّما رَجُلٍ مُسْلِمٍ سَبَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ أوْ كَذَّبَهُ أوْ عابَهُ أوْ تَنْقُصُهُ؛ فَقَدْ كَفَرَ بِاللَّهِ وبانَتْ مِنهُ زَوْجَتُهُ؛ فَإنْ تابَ وإلا قُتِلَ. وكَذَلِكَ المَرْأةُ؛ ‘কোনো মুসলমান যদি রাসুল (স.)-কে গালি দেয় বা তাঁর দোষ বর্ণনা করে অথবা তার সম্মানকে খাটো করে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। এবার যদি সে তাওবা করে তাহলে তা কবুল হবে অন্যথায় তাকে হত্যা করে ফেলা হবে। এই বিধান নারী পুরুষ উভয়ের জন্যে। (কিতাবুল খারাজ: ১৯৯পৃ.)

ইমাম তাহাবি (রহ) বলেন, যে রাসুল (স.)-কে গালি দেবে অথবা তাঁকে খাঁটো করে পেশ করবে এর দ্বারা সে মুরতাদ হয়ে যাবে।… ইমাম জাসসাস (রহ) বলেন, এই কথা থেকে প্রমাণিত হলো—রাসুল (স.)-কে গালি দিলে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায়, অর্থাৎ শাতেম আর মুরতাদের বিধান একই। (শরহে মুখতাসারুত তাহাবি: ৬/১৪১-১৪২, শায়খ সায়েদ বাকদাশ তাহকিককৃত নুসখা)

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) উল্লেখ করেন, সব মাজহাবের ঐকমত্যে সিদ্ধান্ত- নবী কারিম (স.)-এর অবমাননাকারী কাফের; তার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ডই। আল্লামা ইবনে মুনজির (রহ.) বলেন, সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্য হলো, নবী কারিম (স.)-এর অবমাননাকারীর শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড। আল্লামা খাত্তাবি (রহ.) বলেন, নবী (স.)-এর অবমাননাকারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই, এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করেছেন বলে আমার জানা নেই। ইমাম আবু বকর আল ফারেস এবং কাজি আয়াজও ইজমার বিষয়ে একই বক্তব্য পেশ করেছেন।

আরও পড়ুন: অন্য নবীদের তুলনায় প্রিয়নবীজির বিশেষত্ব

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের
ইমাম আবু হানিফা (রহ) এবং ইমাম শাফেয়ি (রহ)-এর মতানুসারে তাকে হত্যা করবে রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধিরা। কিন্তু সাথে সাথে একথাও লিখেছেন যে, যদি কোনো সাধারণ মানুষ তাকে হত্যা করে ফেলে তাহলে তার ওপর কোন শাস্তি আসবে না। কেননা মুরতাদ হওয়ার কারণে লোকটি প্রথমেই তার রক্তকে অন্যের জন্য হালাল করে দিয়েছে। বাদায়েউস সানায়েতে বলা হয়েছে- ‘যদি তাকে কেউ হত্যা করে তওবা করার আগেই তাহলে কাজটি মাকরুহ হলেও হত্যাকারীর উপর কোনো কিছু আবশ্যক হবে না। কেননা মুরতাদ হওয়ার কারণে রাসুলের (স.) অবমাননাকারী প্রথমেই তার রক্তকে অন্যের জন্য হালাল করে দিয়েছে।’ (বাদায়েউস সানায়ে: ৭/১৩)

তবে, বর্তমানে ওলামায়ে কেরাম এমত পোষণ করেন যে, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অবমানকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে চাপ দেবে মুসলিম উম্মাহ। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করবে। নিজের হাতে নবী অবমাননাকারীকে হত্যা করবে না। কারণ এ অনুমতি থাকলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

কটূক্তিকারী থেকে তওবা চাওয়া নিয়ে ইমামদের মধ্যে মতবিরোধ
হানাফি মাজহাবের ফতোয়া হলো— তার নিকট তাওবা তলব করা হবে অথবা সে যদি তাওবা করে, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
ফিকহে মালেকি ও হাম্বলি মতানুযায়ী শাতেমের তাওবা কবুল হবে না। তার থেকে তাওবা চাওয়াও হবে না এবং সে নিজে তাওবা করলেও তা কবুল হবে না। তাঁদের সিদ্ধান্ত হলো, তাকে হত্যা করতে হবে।
শাফেয়ি মাজহাবের ইমামদেরর থেকে বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেলেও মাজহাবের ফতোয়া হলো— শাতেমের তাওবা গ্রহণযোগ্য হবে। সুতরাং তার থেকে তাওবা চেয়ে ইসলামে ফিরে আসতেও বলা হবে। এবং সে নিজে তাওবা করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।

উপরে উল্লিখিত ইমামদের মতামত, ফতোয়া ও আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে— রাসুল (স.)-এর শানে বেয়াদবিমূলক মন্তব্য, বক্তব্য বা তাঁর প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপকারী এবং ধর্মীয় কোনো বিধান নিয়ে ব্যঙ্গকারী উম্মতের সর্বোচ্চ ঐকমত্যে মুরতাদ বলে সাব্যস্ত হবে। তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দায়িত্ব শাসকদের। তাই শাসকদের জন্য আবশ্যক এ ধরনের লোকদের চিহ্নিত করে আইনের মাধ্যমে তাদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সকল শাসককে বিশ্বনবী (স.)-এর ইজ্জত রক্ষার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সাবধান হওয়ার এবং শাতেমে রাসুলের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর