জীবনের অন্তিম মুহূর্তের উপদেশগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে ইসলামে। যাকে বলা হয় অসিয়ত। এই কথাগুলোকে বিশেষভাবে মূল্যায়নের শিক্ষা দেয় ইসলাম। আর অসিয়তকারী যদি হন স্বয়ং রাহমাতুল্লিল আলামিন তাহলে তো কথাই নেই। এর গুরুত্ব তখন প্রকৃত মুসলমানের কাছে হয়ে যায় প্রাণের চেয়ে প্রিয়। উম্মতের দরদি নবী (স.) জীবন সায়াহ্নে এমন কিছু উপদেশ দিয়ে গেছেন, যা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। এখানে নবীজির ১৪টি মহামূল্যবান অসিয়ত তুলে ধরা হলো।
১. নামাজ কখনও ছেড়ে দেবে না
হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (স.)-এর অন্তিম মুহূর্তে তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল এবং তাঁর মুখের ভাষায় এ অসিয়ত ছিল যে, ‘সালাত, সালাত’ (অর্থাৎ নামাজ পড়বে, কখনও নামাজ ছেড়ে দেবে না)। (মুসনাদে আহমদ: ২৬৬৮৪)
বিজ্ঞাপন
২. কোরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরবে
বিদায় হজের ভাষণে রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘..অবশ্যই আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস ছেড়ে যাচ্ছি; যদি তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, কখনই তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না; আর তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। (হাকেম: ৩১৮; সহিহ তারগিব: ৩৬) রাসুল (স.)-এর এ অসিয়তটি কোরআনের অনেক আয়াতে বর্ণিত অসিয়তের মতোই। যেমন—আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না, অথচ তোমরা শুনছ।’ (সুরা আনফাল: ২০)
আরও পড়ুন: যেসব কাজে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ হয়
৩. অধীনস্থের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে
আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অন্তিম মুহূর্তে তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল এবং তাঁর মুখের ভাষায় এ অসিয়ত ছিল যে ...তোমাদের দাস-দাসীর ব্যাপারে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করবে (অর্থাৎ তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে)। (ইবনে হিব্বান: ৬৬০৫)
৪. আমানত রক্ষা করবে
রাসুল (স.) বলেছেন, সাবধান! কারো কাছে অন্যের আমানত থাকলে সে যেন তা আমানতদাতার কাছে দিয়ে দেয়। (মুসনাদে আহমদ: ২০৬৯৫) অন্য হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, যার মধ্যে আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই। (ইবনে হিব্বান: ১৯৪)
বিজ্ঞাপন
৫. শিরকমুক্ত থাকবে
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, যে রোগ থেকে রাসুলুল্লাহ (স.) আর সুস্থ হয়ে ওঠেননি সে রোগাবস্থায় তিনি বলেছেন, ইহুদিদের প্রতি আল্লাহ লানত করেছেন, তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে। (মুসলিম: ৫২৯)
আরও পড়ুন: শিরক না করার কারণে যেসব প্রতিদান পাবেন
৬. বিদআতমুক্ত থাকবে
আল-ইরবাদ (রা.) বললেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (স.) আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সালাত আদায় করলেন, অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন, তাতে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত হলো এবং অন্তরগুলো বিগলিত হলো। তখন এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এ যেন কারো বিদায়ী ভাষণ! অতএব আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দেন? তিনি বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির, শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে (আমীর) একজন হাবশি গোলাম হয়। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলিফাহগণের সুন্নত অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে কামড়ে আঁকড়ে থাকবে। সাবধান! প্রতিটি নব আবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নব আবিষ্কার হলো বেদআত এবং প্রতিটি বেদআত হলো ভ্রষ্টতা। (আবু দাউদ: ৪৬০৭)
৭. সুদের কাছেও যাবে না
সুদ একটি মারাত্মক পাপ। সুদি কারবারির বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে রাসুল (স.) সব ধরনের সুদ বাতিল ঘোষণা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আর জাহেলি যুগের সুদ প্রথা বাতিল ঘোষিত হলো। এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম আমি আমাদের প্রাপ্য সুদ, যা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের সুদ বাতিল ঘোষণা করলাম। (মুসলিম: ১২১৮)
৮. ফিতনা থেকে দূরে থাকবে
রাসুল (স.) সব সময় স্বীয় উম্মতদের ফিতনা থেকে দূরে থাকার আদেশ দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় উম্মতকে ফিতনার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘কেয়ামত কায়েম হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং হারজ বৃদ্ধি পাবে (হারজ অর্থ খুন-খারাবি)। (বুখারি: ১০৩৬)
আরও পড়ুন: হাদিসের বর্ণনায় ফিতনার যুগে মানুষের অবস্থা
৯. দ্বীন প্রচারে আত্মনিয়োগ করবে
আবু বকর (রা.) বিদায় হজের ভাষণ উল্লেখ করে বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, এখানে উপস্থিত ব্যক্তি (আমার এ বাণী) যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়; কারণ উপস্থিত ব্যক্তি হয়তো এমন এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছাবে, যে এ বাণীকে তার থেকে বেশি মুখস্থ রাখতে পারবে। (বুখারি: ৬৭)
১০. নবী-পরিবারকে সম্মান করবে
রাসুল (স.) বলেন, মুহাম্মদ (স.)-এর পরিবারবর্গের প্রতি তোমরা অধিক সম্মান দেখাবে। (বুখারি: ৩৭০১) নবী-রাসুলদের পরিবারকে সম্মানের সপক্ষে পবিত্র কোরআনেও আয়াত নাজিল হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠ। আর তাঁর স্ত্রীরা তাদের মা স্বরূপ।’ (সুরা আহজাব: ৬)
১১. আমিরের অনুসরণ করবে
হে মানবসকল! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করো, তোমাদের ধন-সম্পদের জাকাত আদায় করো এবং তোমাদের আমিরের অনুসরণ করো, তবেই তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (তিরমিজি: ৬১৬)
১২. মুসলিমদের সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট হবে
মুসলমানের সম্মান রক্ষা করা মুমিনের দায়িত্ব। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে। (বুখারি: ১০)
১৩. নারীদের সম্মান করবে
জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে আরাফাতের ময়দানের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো। কেননা তোমরা তাদের আল্লাহর দেওয়া নিরাপত্তার মাধ্যমে গ্রহণ করেছ। আর তাদের লজ্জাস্থান তোমরা হালাল করেছ আল্লাহর কলেমা তথা ওয়াদার মাধ্যমে। (মুসলিম: ১২১৮)
১৪. আনসারদের ভালোবাসবে
হাদিসে এসেছে, ঈমানের চিহ্ন হলো আনসারদের ভালোবাসা এবং মুনাফিকির চিহ্ন হলো আনসারদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা। (বুখারি: ১৭)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রিয়নবী (স.)-এর উল্লেখিত অসিয়তগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন। প্রত্যেক ক্ষেত্রে নবীজির আদর্শ অনুসরণের তাওফিক দান করুন। আমিন।

