দাওয়াত ও তাবলিগ নবী-রাসুলদের কাজ। আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত সকলের অভিন্ন দায়িত্ব ছিল দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলিগ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার আগে যে রাসুলই প্রেরণ করেছি, তার প্রতি অবশ্যই এ ওহি পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। অতএব, আমার ইবাদত করো। (সুরা আম্বিয়া: ২৫)
দাওয়াত-তাবলিগের কল্যাণেই মুসলিম উম্মাহ দ্বীন ইসলামকে চিনতে পেরেছে, গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে। তালিমের মাধ্যমে নিজেদের আকিদা-কর্ম পরিশুদ্ধ করেছে। নবী (স.) প্রথমে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, যারা দাওয়াত কবুল করতেন তাদের গড়ে তুলতেন দ্বীনের তালিম-তাজকিয়ার মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَة ‘মুমিনদের ওপর আল্লাহ বড় অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে এমন একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের সামনে আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমতের তালিম প্রদান করেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৬৪)
বিজ্ঞাপন
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা দাঈদের প্রেরণা দিয়ে বলেন: ‘সে ব্যক্তির চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয় এবং নিজে সৎকাজ করে আর বলে আমি মুসলামনদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা হা-মিম সাজদাহ: ৩৩)
মহানবী (স.) দাওয়াতের এই গুরুদায়িত্ব এই উম্মতের উপর অর্পণ করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেন: ‘হে লোক সকল! তোমরা যারা উপস্থিত আছ তাদের দায়িত্ব হচ্ছে অনুপস্থিতদের এ বাণী পৌঁছে দেওয়া’। (বুখারি: ৪৪০৬) অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আমার একটি বাণী হলেও তোমরা পৌঁছে দাও।’ (বুখারি: ৩৪৬১)
আরও পড়ুন: নবীগণ যে ৬ বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছেন
রাসুল (স.)-এর এই বাণী বাস্তবায়ন তথা দাওয়াতের কাজে সাহাবায়ে কেরাম পৃথিবীর দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েন এবং মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দেন। তাই তো দেখা যায় লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামদের মধ্য থেকে মাত্র অল্প সংখ্যক সাহাবির কবর মক্কা মদিনায় পাওয়া যায়। আর বাকি সাহাবিদের কবর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত।
বিজ্ঞাপন
দাওয়াত মানে আহ্বান, তাবলিগ অর্থ পৌঁছানো। ইসলামের অনুপম আদর্শের প্রতি মানুষকে ডাকা হলো দাওয়াত। ইসলামের কল্যাণের বিষয়গুলো মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়া হলো তাবলিগ। এই দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ থেকে দূরে থাকা অন্তত এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত। তোমাদের মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা মানুষদের সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায়মূলক কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে। এবং আল্লাহ ওপর ঈমান আনবে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১০)
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমাদিগকে কি এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দান করব যা তোমাদেরকে কঠোর আজাব থেকে রক্ষা করবে? তা হলো- তোমরা আল্লাহর ওপর ও আল্লাহর রাসূলের ওপর ঈমান আনবে, মেহনত করবে আল্লাহর রাস্তায় মাল ও জান দিয়ে।’ (সুরা আস-সাফ: ১০)
দাওয়াতি কাজ অনেক মুবারকময় আমল। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর রাস্তায় একটা সকাল বা একটা বিকাল ব্যয় করা সারা দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।’ (বুখারি: ২৭৯২; মুসলিম: ১৮৮০)
অমুসলিমদের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ জিম্মাদারি হলেও মুসলিমদের মাঝেও দাওয়াতি কার্যক্রম থাকতে হবে। কোনো খাস আমল ও বিধানের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার জন্যও দাওয়াত হতে পারে, শিরক-বিদআত ও নাস্তিকতার ব্যাপারে সতর্কতা তৈরির জন্য দাওয়াত হতে পারে। দাওয়াতের আরও অনেক ক্ষেত্র আছে। তাছাড়া এক ময়দানের কাজও কয়েক পদ্ধতিতে কয়েক স্তরে করা যায়। সঠিক নিয়মে যুক্তিতর্ক করা, ওয়াজ-নসিহত করা দাওয়াতেরই এক তরিকা, যার কথা কোরআনে এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন হেকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল: ১২৫)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘এ কোরআন আমার কাছে ওহি হিসেবে পাঠানো হয়েছে, যেন তোমাদের এবং যার কাছে তা পৌঁছবে তাদের এর দ্বারা সতর্ক করতে পারি।’ (সুরা আনআম: ১৯)
তাবলিগ জামাতের ১৯ কার্যক্রম
তাবলিগ জামাতের উদ্দেশ্য
নবীজি ঘরেঘরে গিয়ে, বাজারে-ঘাটে গিয়ে, আবার কাউকে সরাসরি দাওয়াত দিয়েছেন। চিঠির মাধ্যমেও দাওয়াত দিয়েছেন। বিভিন্নভাবে দাওয়াত দেওয়া যায়। মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ)-এরও দাওয়াতের মূল তরতিব ছিল চিঠি। এই উপায়ে দ্বীনি দাওয়াতের বিরাট কাজ আঞ্জাম পেয়েছে। রহমাতুল্লাহ কিরানবী (রহ)-এর দাওয়াত ছিল মোনাজারার মাধ্যমে। তাঁর এই তরিকার দাওয়াতের ফলে কত মানুষের যে ঈমানের হেফাজত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তেমনি জুমার মিম্বর ও মওসুমি মাহফিলের মাধ্যমে দাওয়াতের বিরাট কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন বহু আলেম। বর্তমানে দাওয়াতের প্রয়োজনে অনেকে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করছেন। সুতরাং দাওয়াতকে বিশেষ কোনো তরতিব মনে করার যৌক্তিকতা নেই। বর্তমান তাবলিগ জামাতের গাশতের দাওয়াতও ‘সাবিলুম মিন সুবুলিদ দাওয়াহ’ তথা দাওয়াতের এক পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ফলপ্রসূ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
স্মরণ রাখতে হবে, যেসমস্ত সোনালি উসুলের কারণে এই পদ্ধতি ব্যাপক পরিসরে গ্রহণীয় হচ্ছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, তা ধরে রাখা দরকার। বিশেষ করে সেই বুনিয়াদি উসুলগুলো স্মরণ রেখেই ছয় উসুলের কাজ করতে হবে, কিছুতেই বুনিয়াদি উসুলগুলো বিসর্জন দেওয়া যাবে না। এর প্রথমটি হলো- যারা নেতৃত্ব দেবেন, তারা আকিদা-বিশ্বাসে ও আমলে-আখলাকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারী হবেন। দ্বিতীয় হলো- দ্বীনের অন্য হালকা ও কর্মপন্থার সমালোচনা করা যাবে না। তালিম, সিয়াসত, জিহাদ, খানকা, ওয়াজ-মোনাজারা ইত্যাদি কাজের লোকজনকে বাঁকা চোখে দেখবে না, পারলে সহযোগিতা করবে। তৃতীয় হলো- নিজেরা ফিকহি মাসআলা মেনে চলবে। মাসআলা শিখবে আলেমগণের কাছে গিয়ে। কিন্তু এই জামাতের মিম্বর থেকে ফতোয়া বা মাসআলা দেওয়া হবে না। অন্য মাজহাব অনুসরণের ব্যাপারে সাধারণ কাউকে বাধা দেওয়া হবে না। চতুর্থ হলো- কেন্দ্র থেকে সাধারণ স্তর পর্যন্ত সবাই মশওয়ারাসাপেক্ষে কাজ করবে। মশওয়ারা ব্যতীত একক সিদ্ধান্তে কোনো কাজ চলবে না।
আরও পড়ুন: ঈমান মজবুত হয় যেসব আমলে
এগুলো হল উসুলের উসুল। এগুলো লঙ্ঘন হলে বরকত কমে যাবে। এই নীতিগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে, মারকাজে কতটুকু অনুসৃত হচ্ছে মুরুব্বিদেরকেই তদারকি করতে হবে। আসুন আমরা সবাই এই উসুলগুলো জিন্দা করি।
আর দাওয়াতি কাজে অংশ নিতে পেরে আত্মতৃপ্ত হওয়া যাবে না। মুসলিম উম্মাহ প্রধানত তিন ময়দানে দায়িত্ব পালন করে। ১. দাওয়াত-তাবলিগ ২. তালিম-তাজকিয়া ৩. জিহাদ-সিয়াসত। দাওয়াত ও তাবলিগ হলো উম্মাহর অন্যতম প্রধান ময়দান। এতে অংশ নিয়ে অন্য ময়দানের কর্মীকে তুচ্ছ ভাবা মারাত্মক অন্যায় ও হারাম! সবাই সবার সহযোগী হবে। এক ময়দানের গুরুত্ব দিতে গিয়ে আরেক ময়দানকে ছোট করা বড় ধরনের আত্মপ্রতারণা। আসুন নিজেদের মানসিকতা পরিশুদ্ধ করি। ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধান গ্রহণ করি। দ্বীনের এই মোবারক জামাতকে আপন করি। কাজ নিয়ে বেশি বেশি বের হওয়ার ফিকির করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।

