ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মীয়-স্বজনের পারস্পরিক যাতায়াত প্রশংসনীয় কাজ। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং এতে অনেক সওয়াব লাভ হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) জনৈক ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশকারী আমল সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেন, وَتَصِلُ الرَّحِمَ ‘তুমি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে।’ (বুখারি: ১৩৯৬; আদাবুল মুফরাদ: ৪৯) হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যে আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (সহিহ বুখারি: ৬১৩৮)
যোগাযোগ রক্ষা করা মূলত আত্মীয় স্বজনের হক বা অধিকার। এই হক আদায় না করলে গুনাহগার হতে হবে। এমনকি কেউ বিচ্ছিন্ন থাকলেও তার সঙ্গে অন্যরা যোগাযোগ রক্ষা করবে—এটাই ইসলামি নির্দেশনা। যে নিজের উদ্যোগে যোগাযোগ রক্ষা করে সে উত্তম। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘... প্রকৃত আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী সে, আত্মীয় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও যে তা রক্ষা করে চলে।’ (সহিহ বুখারি: ৫৯৯১)
বিজ্ঞাপন
সাধ্য থাকলে নাস্তা-পানি বা উপহার নেওয়া সুন্নত। এতে পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা বাড়ে। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘তোমরা একে অন্যকে উপহার দাও, ভালোবাসা সৃষ্টি হবে।’ (আলআদাবুল মুফরাদ: ৫৯৪) তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। আত্মীয় স্বজনকে সাধ্যের বাইরে দামি খাবার খাওয়ানো যেমন জরুরি নয়, দাওয়াতে অবশ্যই উপহার নিয়ে যেতে হবে- এমন ভাবনাও সঠিক নয়।
কোরআনের নির্দেশমতে, আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে হবে এবং মেহমানদারি করতে হবে। সব নবী ও রাসুল অতিথিপরায়ণ ছিলেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) আতিথেয়তায় ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। তিনি দিনে অন্তত এক বেলা মেহমান ছাড়া আহার করতেন না বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। আমাদের প্রিয়নবী (স.) মেহমানদারিকে ঈমানের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন মেহমানকে সম্মান করে।’ (সহিহ বুখারি: ৬১৩৮)
আন্তরিকতাপূর্ণ অনাড়ম্বর মেহমানদারির কথা এসেছে কোরআন ও হাদিসে। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘উপস্থিত খাবারকে তুচ্ছ মনে করা মেহমানদের জন্য বিপজ্জনক। আর ঘরে যা আছে মেহমানের সামনে পেশ করতে লজ্জা পাওয়া মেজবানের জন্যও বিপজ্জনক’ (শোয়াবুল ঈমান)। (যার বাড়িতে মেহমান গেছেন, তাকে মেজবান বলে।) উত্তম মেহমানদারি ও আপ্যায়ন প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা নিজের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যদিও নিজেরা ক্ষুধার্ত থাকে। আর যারা স্বভাবজাত লোভ-লালসা এবং কামনা থেকে মুক্তি লাভ করে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর: ৯)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: কোরআনের দৃষ্টিতে যারা সফলকাম
মেহমান খাবে কি খাবে না—এমন প্রশ্ন করা মেজবানের জন্য শোভনীয় নয়। বরং কোনো জিজ্ঞাসা ছাড়াই মেহমানের সামনে খাবার পরিবেশন করা সুন্নত। সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বলেন, ‘কেউ তোমার কাছে বেড়াতে গেলে খাবেন কি-না প্রশ্ন করো না। খাবার সামনে হাজির করবে। তিনি খেলে তো খেলেন; না খেলে তুলে নেবে। (আদাবুজ জিয়াফা)
প্রয়োজনীয় আলাপ আলোচনা ও খাবার গ্রহণশেষে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে খুশিমনে মেহমানের ফিরে আসা উচিত। অনর্থক খোশ-গল্প করে সময় অতিবাহিত করে মেজবানের কাজে ব্যাঘাত ঘটানো সমীচীন নয়। বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘অতঃপর খাওয়া শেষে বেরিয়ে পড়ো। অহেতুক গল্প-গুজবে রত হয়ো না।’ (সুরা আহজাব: ৫৩)
খাবার শেষে মেজবানের জন্য দোয়া করা সুন্নত। দুটি সুন্দর দোয়া এখানে তুলে ধরা হলো। (এক) اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِيْمَا رَزَقْتَهُمْ وَاغْفِرْلَهُمْ وَارْحَمْهُمْ ‘আল্লা-হুম্মা বা-রিক লাহুম ফীমা রাঝাক্বতাহুম ওয়াগফির লাহুম ওয়ারহামহুম।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তুমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছ তাতে তুমি বরকত দান কর, তাদেরকে ক্ষমা করে দাও এবং তাদের উপর রহমত বর্ষণ কর।’ (মুসলিম: ২০৪২; মেশকাত: ২৩১৫) (দুই) اللَّهُمَّ أَطْعِمْ مَنْ أَطْعَمَنِى وَأَسْقِ مَنْ أَسْقَانِى ‘আল্লা-হুম্মা আত‘ঈম মান আত‘আমানী ওয়াসক্বি মান আসক্বানী।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে খাদ্য খাওয়াও যে আমাকে খাবার খাইয়েছে। আর তাকে পান করাও যে আমাকে পান করিয়েছে।’ (মুসলিম: ৫৪৮৩, ‘অতিথির সমাদর’ অনুচ্ছেদ)
আপ্যায়নকারী কষ্ট করে সাধ্যমত আপ্যায়ন করল, এজন্য তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত। হাদিস অনুযায়ী, যে মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে রাসুল (স.) বলেন, ‘যে লোক মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না, সে আল্লাহ তাআলারও কৃতজ্ঞতা আদায় করে না।’ (তিরমিজি: ১৯৫৫; মেশকাত: ৩০২৫; সহিহাহ: ৬৬৭)
আরও পড়ুন: কেউ উপকার করলে যে দোয়া করবেন
মেহমান চলে যাওয়ার সময় তাকে এগিয়ে দিয়ে আসা মেজবানের জন্য সুন্নত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তির মেহমানের সঙ্গে (বিদায়কালীন) বাড়ির দরজা পর্যন্ত সঙ্গ দেওয়া সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। (মেশকাত)
মেহমানকে বিদায় দেওয়ার সময় একটি দোয়া পড়া সুন্নত। রাসুল (স.) তাঁর সেনাবাহিনীকে বিদায় দেওয়ার সময় এই দোয়া পড়তেন— أَسْتَوْدِعُ اللَّهَ دِينَكُمْ وَأَمَانَتَكُمْ وَخَوَاتِيمَ أَعْمَالِكُمْ ‘আসতাও দিউল্লাহা দীনাকুম, ওয়া আমানাতাকুম, ওয়া খাওয়াতিমা আ’মালিকুম।’ অর্থ: ‘আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের দীন, আমানত ও সর্বশেষ আমলের হিফাজতের জন্য দোয়া করছি।’ (আবু দাউদ: ২৬০১)
নাতিদীর্ঘ আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া, আত্মীয়ের খোঁজখবর নেওয়া এবং মেহমানের যথাসাধ্য কদর করা অনেক ফজিলতপূর্ণ সুন্নত আমল। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এই যাতায়াত, যোগাযোগের মধ্যে নবীজির অনেক সুন্নতের ব্যবহার লক্ষণীয়। আর যতবেশি সুন্নতের অনুসরণ হয়, মুসলমান তত বেশি সফল। মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মাগফেরাত ও জান্নাত লাভ করতে হলে জীবনের সব ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (স.) এর সুন্নাহর অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে, তোমাদের মধ্যে যারা পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহকে খুব বেশি করে স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর জীবনে সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে’ (সুরা আহজাব: ২১)। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নত অপছন্দ করল তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (বুখারি: ৪৭৭৬)
উল্লেখ্য, অভাবগ্রস্ত আত্মীয়কে সহযোগিতা করা, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া এবং কারো মধ্যে দীনের ব্যাপারে গাফিলতি দেখলে তাকে সতর্ক করাও আত্মীয়ের হক। (সূত্র: নাসায়ি: ২৫৮২; সহিহ বুখারি: ৫৩৭৩; সুরা তাহরিম: ৬)। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আত্মীয়তা রক্ষার ব্যাপারে, হক আদায়ের ব্যাপারে সচেতন ও সাবধান হওয়ার তাওফিক দান করুন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে নবীজির সুন্নত অনুসরণের তাওফিক দান করুন। আমিন।