-
সিলিকা ধুলো ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে
-
দূষণের ‘হটস্পট’ ৭ অঞ্চল
-
পুরোনো যানবাহন বায়ু দূষণ বাড়াচ্ছে
-
ঢাকার বাতাস অদৃশ্য খুনি
-
বায়ু দূষণে আইনের কার্যকর প্রয়োগ থাকা প্রয়োজন-পরিবেশবিদ
ঢাকার বাতাসের অদৃশ্য খুনি ধুলো এবং দূষণ এখন নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। বাতাসে সূক্ষ্ম কণার ঘনত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে, যার মধ্যে শ্বাসযোগ্য সিলিকা ধুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এটি সরাসরি ফুসফুসে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর গাবতলী–আমিনবাজার, যাত্রাবাড়ী–ডেমরা, উত্তরা–আব্দুল্লাহপুর, কাঁচপুর–সোনারগাঁও, মুগদা–বাড্ডা—সহ মোট সাতটি করিডোর দূষণের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন—ধুলো নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, ত্রিপল ছাড়া বালু পরিবহন, রাস্তার ওপর সিমেন্ট–বালুর স্তূপ, নির্মাণস্থলে ইটভাঙা এবং সড়কে জমে থাকা ধুলো সিলিকার ঘনত্ব আরও বাড়াচ্ছে। এভাবে ধুলো ও বায়ুদূষণ প্রতিনিয়ত ঢাকাবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে, কাহিল হয়ে পড়েছে জনজীবন।
আরও পড়ুন:
বায়ুদূষণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমছে সাড়ে ৫ বছর
আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণ রোধে আঞ্চলিক পদক্ষেপের আহ্বান রিজওয়ানার
সাম্প্রতিক দুটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা দেখিয়েছে, রাজধানীর বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণা, ক্ষতিকর গ্যাস এবং শ্বাসযোগ্য সিলিকা ধুলোর ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ সীমাকে বহু গুণ ছাড়িয়ে গেছে। এই অবস্থায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ঢাকার বাতাস অদূর ভবিষ্যতে মানুষের বসবাসের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠবে। শ্বাসতন্ত্রের অসুখ থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি ক্যানসার পর্যন্ত ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।
বিজ্ঞাপন
একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে জিএসসি উন্নত গবেষণা ও সমীক্ষা জার্নালে এবং শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ঢাকার ভয়াবহ বায়ুদূষণ আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আরেকটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার বাতাসে শ্বাসযোগ্য সিলিকার মূল্যায়ন এবং মানবস্বাস্থ্যের ঝুঁকি শিরোনামে। উভয় গবেষণাই ২০২৫ সালের শুরুতে পরিচালিত হয়েছে এবং ঢাকার বায়ুদূষণের উৎস, মাত্রা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির গভীর বিশ্লেষণ করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে ঢাকার বাতাস সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়। বাতাস স্থির থাকে, আর্দ্রতা কমে যায় এবং সূক্ষ্ম কণার ঘনত্ব হঠাৎ বেড়ে যায়। এই সময় বাতাসে ধুলো, সালফার ডাই–অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড এবং ওজোনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। এখন ঢাকার বায়ুদূষণ আর মৌসুমি সমস্যা নয়, বরং সারা বছরের জনস্বাস্থ্য সংকট।
রাস্তার ধুলো এবং নির্মাণসামগ্রীর উন্মুক্ত স্তূপ ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস। ভাঙাচোরা সড়ক, গাড়ি চলাচল এবং মানুষের হাঁটাচলায় মাটি ও ধুলো বাতাসে উঠে। বালু, ইটভাঙা এবং সিমেন্ট খোলা জায়গায় রাখা হলে ধুলো প্রতিদিন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই উৎস থেকেই ঢাকার মোট দূষণের বড় অংশ উৎপন্ন হয়। খোলা বালুবোঝাই ট্রাক, অপরিকল্পিত নির্মাণস্থল এবং ত্রিপল ছাড়া পরিবহন বায়ুদূষণকে আরও তীব্র করছে।
যানবাহন ও শিল্প এলাকা দ্বিতীয় প্রধান দূষণ উৎস। পুরোনো বাস, ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যান মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার করে না। ডিজেলচালিত যানবাহন সূক্ষ্ম কণার ঘনত্ব বাড়াচ্ছে। রাস্তার পাশে থাকা ছোট শিল্পকারখানার অদৃশ্য ধোঁয়া বায়ুতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। বায়োমাস পোড়ানো, আবর্জনা দাহ বা বর্জ্য পোড়ানোর প্রবণতা ধোঁয়াশা তৈরি করছে। ঢাকার দক্ষিণাঞ্চল, যেখানে শিল্পকারখানার ঘনত্ব বেশি, সেখানে বাতাসের মান সবচেয়ে খারাপ।
গবেষণাটি বলছে, ইটভাটাও দূষণের চিরস্থায়ী উৎস। সাভার–আশুলিয়া, ডেমরা–রূপগঞ্জ, আমিনবাজার–গাবতলী অঞ্চলে কয়লাচালিত চুল্লির ধোঁয়া দীর্ঘ সময় বাতাসে ঝুলে থাকে। পুরোনো প্রযুক্তির ইটভাটায় যথেষ্ট ফিল্টার ব্যবস্থা নেই। গবেষকরা সতর্ক করেছেন—অবৈধ ইটভাটা বন্ধ না হলে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে দূষণ কমানো অসম্ভব।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, ঢাকার বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণার একটি বড় অংশ শ্বাসযোগ্য সিলিকা ধুলো। এটি ফুসফুসে সরাসরি প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সৃষ্টি করে। গাবতলী–আমিনবাজার, যাত্রাবাড়ী–ডেমরা, উত্তরা–আব্দুল্লাহপুর, কাঁচপুর–সোনারগাঁও এবং মুগদা–বাড্ডা করিডোরে সিলিকা ধুলোর মাত্রা নিরাপদ সীমার তিন থেকে বারো গুণ বেশি। ত্রিপল ছাড়া বালু পরিবহন, রাস্তার ওপর সিমেন্ট–বালুর স্তূপ, নির্মাণস্থলে ইটভাঙা এবং সড়কে জমে থাকা ধুলো সিলিকার ঘনত্ব বাড়াচ্ছে। শীতকালে বাতাস স্থির থাকায় সিলিকা দীর্ঘ সময় বাতাসে ঝুলে থাকে এবং অন্যান্য সময়ের চেয়ে ৩০–৫০ শতাংশ বেশি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূষণ শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, হৃৎরোগ এবং জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। চোখের প্রদাহ, ত্বকের সমস্যা এবং অ্যালার্জিও বেড়েছে। দীর্ঘমেয়াদে সিলিকা ধুলো ফুসফুসে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে, যা সিলিকোসিস নামে পরিচিত এবং সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। পরিবেশেও প্রভাব ভয়াবহ। গাছের পাতায় ধুলো জমে খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। গাছের বৃদ্ধি কমছে, শস্যক্ষেতের উৎপাদন কমছে। নদীর পানি অ্যাসিডিক হয়ে জলজ প্রাণী হুমকিতে পড়ছে। রাজধানীর অনেক অঞ্চলে গাছের বার্ষিক বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে।
ধুলা ছড়ানো এলাকায় চলাচলকারী ও বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন বাইরে বের হওয়ার সময় ধুলোয় ঢেকে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। তারা বলেন, রাস্তা ধরে চলার সময় ধুলোতে ঢেকে যাওয়ায় শ্বাসকষ্ট হয় এবং ছোটদের স্কুলে পাঠানোও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তারা উল্লেখ করেন, ত্রিপল ছাড়া বালু পরিবহন, রাস্তার ওপর সিমেন্ট–বালুর স্তূপ, নির্মাণস্থলে ইটভাঙা এবং সড়কে জমে থাকা ধুলো সিলিকার মাত্রা বাড়াচ্ছে। এছাড়া পুরোনো যানবাহনের ধোঁয়াও বাতাসে ক্ষতিকর কণিকার মাত্রা বৃদ্ধি করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যদি দ্রুত কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ধুলোজনিত শ্বাসকষ্ট, দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের সমস্যা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যের ঝুঁকি ঢাকাবাসীর জন্য সাধারণ হয়ে যেতে পারে।
গাবতলী এলাকার বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, রাস্তার ধুলো এতই বেশি যে হাঁটতে গিয়েই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ছোটদের স্কুলে পাঠানোও ভয়ঙ্কর মনে হয়। যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম নামে এক নারী জানান, নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে আসা ধুলো আর যানবাহনের ধোঁয়া মিলিয়ে বাইরে বের হওয়া এখন প্রায় অসম্ভব। বারবার কাশি ও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শীতকালে বাতাস স্থির থাকায় ধুলো আরও দীর্ঘসময় বাতাসে থাকে, চোখে ঝাপসা এবং গলায় খসখসানি সৃষ্টি করে। আমরা ভাবছি, এই পরিস্থিতি কত দিন থাকবে।
নীতিগত ব্যর্থতা
গবেষকরা বলছেন, নীতিগত ব্যর্থতা সমস্যার মূল। পরিবেশ আইন থাকলেও প্রয়োগ দুর্বল। নির্মাণসামগ্রী খোলা রাখার নিষেধাজ্ঞা মানা হয় না। ইটভাটার নীতিমালা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না। যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা ঠিকমতো হয় না। শহরে বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ও অনুপস্থিত। বিচ্ছিন্ন বা মৌসুমি উদ্যোগে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা। নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, ইটভাটাকে আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর, পুরোনো যানবাহন ধাপে ধাপে বন্ধ, সড়কে নিয়মিত পানি ছিটানো, পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং জোরদার, সিটি করপোরেশনে বিশেষ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সেল গঠন এবং সবুজায়ন বাড়ানো ছাড়া ঢাকার বাতাস শ্বাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। পদক্ষেপ না নিলে এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি ও ভয়াবহ হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আসলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন, যদি ঘরের ভিতরে থাকি, তাহলে ঘরের ভেন্টিলেশন ঠিকভাবে রাখতে হবে। বাতাস যাতে একদিকে প্রবেশ করে আর অন্যদিকে বের হয়, সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে। রান্নাঘরের ধোঁয়া যেন ঘরের ভিতরে না আসে। এছাড়া ঘরে নিয়মিতভাবে মশারি, এসি, পর্দা, কার্পেট ইত্যাদি পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন। এগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইনডোরে করা দরকার।
কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। যেসব এলাকায় ধুলাবালি বেশি, সেগুলো আগে থেকে এড়িয়ে চলা ভালো। যদি কঠিন হয়, তবে সেটি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে সক্রিয়ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা, বায়ু নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন রুল রয়েছে। এগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে ধীরে ধীরে দূষণ কমবে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন আর কোনোভাবেই রাস্তায় চলতে দেওয়া উচিত নয়। সম্ভব হলে আজই এসব যানবাহন বন্ধ করা উচিত।
ড. কামরুজ্জামান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে নির্মাণকাজ শুরু করেছে অনেক আগে, এখানো ঠিক করা হয়নি। এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে দেশের নির্মাণ ক্ষেত্রে পরিবেশ–সম্মত সংস্কৃতি এখনও গড়ে উঠেনি। যতক্ষণ নির্মাণ–সংশ্লিষ্টরা পরিবেশ সচেতন হবেন না, ততক্ষণ দূষণ কমানো সম্ভব নয়। শহরের মানুষের প্রধান ভোগান্তি হলো রাস্তা খোঁড়া করে এবং নির্মাণসামগ্রী রাস্তার ওপর রাখা। পরিবেশ মন্ত্রণালয় বিদেশ থেকে আসা ট্রান্সবাউন্ডারি দূষণ দেখায়, কিন্তু ঢাকার ভেতরের দূষণ তারা ঠিকমতো দেখছে না। তাই স্থানীয়ভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। এখানে শুধুমাত্র সচেতনতা বা মানসিক উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। আইনের সঠিক প্রয়োগ ছাড়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। যেমন ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কেউ হর্ন বাজায় না, নিয়ম ভাঙে না—সেটি শুধুমাত্র সচেতনতায় নয়, সিস্টেম এবং আইন প্রয়োগের কারণে সম্ভব। সারা শহরে এমন সিস্টেম ও আইনের কার্যকর প্রয়োগ থাকা প্রয়োজন।
এএইচ/কে.এম

