সোমবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চাপ, বেকারত্বে বাড়ছে মানসিক রোগী, ৯২ শতাংশই চিকিৎসার বাইরে

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১০:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

Mental
বেকারত্ব এবং সাংসারিক ঝামেলাসহ নানা কারণে মানুষ মানসিক সমস্যায় ভোগে। প্রতীকী ছবি
# প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
# শিশু-কিশোরের ১৩ শতাংশ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত।
# প্রতি ছয় লাখ মানুষের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ।
# মোবাইলে আসক্তি শিশু-কিশোরদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে।
# সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে ২৫-৩০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেন।

দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও। তবু দেশের স্বাস্থ্যখাতে মানসিক স্বাস্থ্য রয়ে গেছে সবচেয়ে উপেক্ষিত জায়গায়। কয়েক বছর ধরে এই খাতে হয়নি কোনো জাতীয় জরিপ বা গবেষণা। চিকিৎসায়ও রয়েছে নানা সংকট—উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নেই সরকারিভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, আর সচেতনতায়ও বড় ঘাটতি রয়ে গেছে সর্বত্র।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশে বর্তমানে কতজন মানসিক রোগে ভুগছেন তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে গত ছয় বছরে কোনো জরিপ বা গবেষণা নেই। তবে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ২০১৮-১৯ সালে একটি জরিপ চালায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

ওই জরিপে দেখা যায়, দেশে লঘু থেকে গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা প্রাপ্তবয়স্কের হার ১৭ শতাংশ। (নারী ১৯ ও পুরুষ ১৫ শতাংশ)। ১৮ বছরের নিচের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। বর্তমানে দেশে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সংখ্যা এক হাজারেরও কম। ফলে মানসিক সমস্যায় ভোগা ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ চিকিৎসার বাইরে রয়ে গেছেন।

2
মানসিক সমস্যায় ভোগা এক নারীর প্রতীকী ছবি।

বেকারত্বে বাড়ছে বিষণ্নতা

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বেকারত্বের কারণে দেশের ব্যাপকহারে বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। বিশেষত তরুণ-তরুণীদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এছাড়া অনেক মানুষই হারাচ্ছেন কাজ। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত পরিশ্রম, কম পারিশ্রমিক, কর্মী ছাঁটাই, কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টি, সহকর্মীদের অসহযোগিতা, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবস্থান হারানোর ভয়ে মূলত কর্মীরা বিষণ্নতায় ভোগেন। কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচ জনের একজন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। আর তাদের মধ্যে গুরুতর মানসিক অসুস্থতার জন্য ৮০ শতাংশ কাজ হারান।

শিশু-কিশোররাও ঝুঁকিতে

বিশেষজ্ঞরা জানান, ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগে ভোগার হার প্রায় ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ কখনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসেনি। সঠিক সময়ে চিকিত্সা নিলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মানসিক রোগী সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে যায়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও কর্মক্ষম। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে স্বীকৃতি না পাওয়া, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও হতাশা থেকেই তারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮ দশমিক ৪ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক ও ১৩ ভাগ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে আক্রান্ত, যা মোট সংখ্যার হিসেবে প্রায় ৪ কোটি। আর তাদের মধ্যে ৯২ শতাংশ মানুষই আছেন চিকিত্সাসেবার বাইরে।

3
মানসিক সমস্যায় ভোগা এক পুরুষের প্রতীকী ছবি।

দুর্যোগে বাড়ে মানসিক সমস্যা

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. নিলুফার আখতার জাহান বলেন, ‘দুর্যোগ বা জরুরি পরিস্থিতিতে শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক প্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়। যেমন দুশ্চিন্তা, হতাশা, রাগ, ঘুমের সমস্যা ও কাজের প্রতি অনাগ্রহ। দুর্যোগের পর প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ মৃদু মানসিক রোগে (ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার ও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার-পিটিএসডি) এবং ৯ শতাংশ গুরুতর রোগে (সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিসঅর্ডার) আক্রান্ত হন।’

নিলুফার আখতার বলেন, ‘বড় দুর্ঘটনা বা বিপর্যয়ের পর যদি এক মাসের মধ্যে মানসিক চাপ কমে না যায়, তাহলে পিটিএসডিতে রূপ নিতে পারে। যার লক্ষণ হলো বারবার একই ঘটনার স্মৃতি বা দুঃস্বপ্ন দেখা ও তা এড়িয়ে চলার প্রবণতা। পুলিশসহ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ রোগের ঝুঁকি রয়েছে।’

মাদক ও বেকারত্ব প্রতিরোধ জরুরি

মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে মাদক প্রতিরোধের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অনেক রোগ প্রতিরোধ করতে হয়, মাদককেও প্রতিরোধ করতে হবে। দিন দিন মাদকাসক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এদিকে নজর দেওয়া দরকার। যৌথ উদ্যোগে অভিযানও চালাতে পারে এবং মাদক প্রতিরোধে কার্যকর কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে।’

তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘প্রতিটি স্কুল-কলেজের শিশু-কিশোর মানসিক স্বাস্থ্য ও আচরণগত দিক মনিটর করতে হবে। মানসিক রোগ মানে পাগল নয়। যেতে হবে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। নিউরোলজিস্টের কাছে। এই ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। শারীরিক রোগটাকে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনি মানসিক রোগকেও গুরুত্ব দিতে হবে।’

প্রখ্যাত এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় থাকেন, তাদের মধ্যে অনেকেই মানসিক রোগে ভুগতে থাকেন। তাদেরকেও সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে। এছাড়া বর্তমানে তরুণ-তরুণীরা সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপে ভুগছেন। পড়াশোনা শেষে চাকরি না পাওয়া, সামাজিক প্রতিযোগিতা ও হতাশা সব মিলিয়ে তারা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বেকারত্ব রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

4
মানসিক সমস্যায় ভোগা এক নারীর প্রতীকী ছবি।

চিকিৎসায় ঘাটতি ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা

দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কাঠামো এখনো সীমিত। ঢাকায় একটি বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও পাবনায় একটি কেন্দ্র ছাড়া জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কোনো সরকারি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই।

ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নেওয়ারও সংকট রয়েছে দেশে। ঢাকায় একটি বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট এবং পাবনায় একটি কেন্দ্র রয়েছে। আর প্রত্যেকটি সরকারি মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে একটি করে বিভাগ রয়েছে। এছাড়া জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে মানসিক রোগের কোনো চিকিৎসা হয় না। বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসা নিতে পারছেন না কিংবা সুযোগ পাচ্ছেন না। সেইসঙ্গে অনেকেই রোগীই চিকিৎসার আওতায় আনা যাচ্ছে না।’

তথ্যমতে, দেশে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা মাত্র ৩৫০ জন। অর্থাৎ দেশে প্রায় ছয় লাখ মানুষের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক সেবা কার্যত অনুপস্থিত।

তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাইকোলজিস্ট আছেন ৫৬৫ জন, সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার মাত্র সাত জন, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ৩২৪ জন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাধারণ চিকিৎসক ২১ হাজার ২৬৭ জন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী ৯ হাজার ৪০০ জন, হাসপাতালে কর্মরত সেবিকা ৭০০ জন, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স ২৮ হাজার ১৬৫ জন, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমাম আছেন ১৭২ জন।

5
মানসিক সমস্যায় ভোগা এক পুরুষের প্রতীকী ছবি।

শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারে তদারকির পরামর্শ

শিশুদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে প্রযুক্তি ব্যবহারে তদারকি করার পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা।

মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাদিয়া আফরিন বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলার সুযোগ নেই। কারণ তারাও স্বতন্ত্র মানুষ, যাদের নিজস্ব মানসিক বিকাশ ও চাপ মোকাবিলার ক্ষমতা রয়েছে। শিশুদের মানসিক চাপের প্রকাশ আচরণের পরিবর্তনের মাধ্যমে ধরা পড়ে, যেমন হঠাৎ স্কুলে না যেতে চাওয়া, বন্ধুবিচ্ছিন্নতা, ঘুমের সমস্যা বা অতিরিক্ত রাগ-আবেগের বহিঃপ্রকাশ।’

সাদিয়া আফরিন জানান, বর্তমান সময়ে শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির অন্যতম কারণ মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট আসক্তি, যা একমুখী যোগাযোগ সৃষ্টি করে ও সামাজিক-আবেগীয় বিকাশ ব্যাহত করে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারে তদারকি ও সীমা নির্ধারণের পাশাপাশি খেলাধুলা, সৃজনশীলতা ও পারিবারিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

চাপমুক্ত থাকার পরামর্শ

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘সবসময় নানা দুশ্চিন্তা এবং চাপে থাকার কারণে মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে মানুষ বিভিন্ন রকম খারাপ পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো আত্মহত্যা।’

আরেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘মানসিক কোনো সমস্যা থাকলে একজন মানুষের মধ্যে যে সম্ভাবনার জায়গাগুলো থাকে, সেগুলো নানাভাবে বন্ধ হয়ে যায়।’

এসএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর