অতি প্রয়োজনের সময় ও সঙ্কটময় মুহূর্তে মিলছে না স্বাস্থ্যসেবা। অগ্নিকাণ্ডসহ বড় ধরনের যেকোনো দুর্ঘটনা এবং ভূমিকম্পের মতো হঠাৎ আসা দুর্যোগে দেশের হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা বহুদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ।
সম্প্রতি উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পর জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার চিত্র আরও একবার স্পষ্ট হয়েছে। ফলে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের স্বাস্থ্যখাতের সক্ষমতা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠেছে।
বিজ্ঞাপন
এভাবে দশকের পর দশক ধরে অকার্যকর অবস্থায় পড়ে রয়েছে দেশের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত কি কেবল মৃত্যুর হিসাব রাখার জন্য? এই দুরাবস্থার উন্নতি কি আদৌ হবে না?
বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ ৬৫ হাজার মানুষ দগ্ধ বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। এর মধ্যে ২৭ হাজারের বেশি রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং প্রায় ৫ হাজার ৬০০ জন মারা যান।
এর মধ্যে শিশু ও কিশোররা থাকে বিশেষভাবে ঝুঁকিতে। প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার শিশু দগ্ধ হয়। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব নয়; এটি দেখায়, জরুরি চিকিৎসা অবকাঠামোর দুর্বলতা কীভাবে প্রতি বছর হাজারো মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের সময় হাসপাতালের সীমিত বেড, আইসিইউ ঘাটতি ও ওষুধের সংকট চিকিৎসা কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছিল।

একই চিত্র দেখা গেছে ২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড এবং ২০২৩ সালে বেইলি রোড ট্র্যাজেডির সময়েও। উভয় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই গুরুতর আহতদের দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত বার্ন ইউনিট ছিল না, প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক দল ছিল অনুপস্থিত এবং সমন্বিত জরুরি রেসপন্স সিস্টেম ছিল অকার্যকর।
দুর্ঘটনার পর প্রথম এক ঘণ্টা, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ নামে পরিচিত। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ‘গোল্ডেন আওয়ার’ নষ্ট হওয়া। যে সময় আহতের জীবন বাঁচানোর জন্য জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার কথা, সে সময় বাংলাদেশে অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকে যানজটে। জরুরি লেন নেই, প্যারামেডিক টিম নেই, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই।
উন্নত দেশে যেখানে রাস্তাতেই চিকিৎসা শুরু হয়, বাংলাদেশে সেখানে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই অসংখ্য প্রাণ ঝরে যায়। হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলেও শুরু হয় আরেক বিড়ম্বনা– এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে রোগী স্থানান্তরের প্রবণতা।
রাজধানীকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে জেলা পর্যায়ে কোনো ট্রমা সেন্টার বা বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট নেই। বড় দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের ঢাকা পাঠানো ছাড়া বিকল্প থাকে না। দীর্ঘ পথের এই যাত্রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর জীবন কেড়ে নেয়।
অন্যদিকে, দেশের প্রায় লক্ষাধিক প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল এখনো ১৯৮২ সালের অর্ডিন্যান্সের অধীনে চলছে। আধুনিক কোনো সুপারভিশন বা মনিটরিং সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। ফলে বেসরকারি খাতের লাগামহীন বাণিজ্যিকীকরণ রোগীর নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকিতে ফেলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে জাতীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। জেলা পর্যায়ে ট্রমা সেন্টার, প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ, আধুনিক অ্যাম্বুলেন্সসেবা চালু করতে হবে। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যখাতে বাড়াতে হবে লোকবল। যাতে করে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আব্দুস সবুর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দুর্ঘটনাসহ সব ধরনের জরুরি স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারের এক ধরনের উদাসীনতা রয়েছে। অন্তত জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে একটি করে ইউনিট রাখা যায়, যারা জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করবেন। তাদের কাজ হবে দুর্ঘটনা বা এ সংক্রান্ত রোগীদেরকে সেবা দেওয়া। তাতে জেলা পর্যায়ে যারা থাকেন, তারা আস্থা ফিরে পাবেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন করতে হলে সারাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মান এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেবা নেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে জনগণকে ভালো স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্য ঢাকায় আসতে না হয়। ঢাকা থেকে যে সেবাটা নেওয়া যায়, সেটা যেন জেলা পর্যায়েও পাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারকে আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
এসএইচ/এএইচ

