গত ১৩ মে দুপুর সাড়ে ১২টা। স্থান রাজধানীর জিয়া উদ্যান। খোলামেলা জায়গাতেই স্কুল ড্রেস পরা চার তরুণ একসঙ্গে সিগারেট টানছে আর গল্প করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হেলায়-ফেলায় সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে স্কুলপড়ুয়া এই চার তরুণ।
জানতে চাইলে দশম শ্রেণি পড়ুয়া সাকিব হাসান (ছদ্মনাম) ঢাকা মেইলকে বলল, ‘আমার আগে সিগারেট টানার অভ্যাস ছিল না। চার-পাঁচ মাস হয়েছে নিয়মিত সিগারেট খাচ্ছি। আমার একটা ‘দুঃখ’ ছিল, এক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করি। ওই বন্ধু নিয়মিত সিগারেট টানত, তার সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে আমিও সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছি। এখন সিগারেট না খেলে ভালো লাগে না, টানতে ইচ্ছা করে।’
বিজ্ঞাপন
সেই স্কুলছাত্র বলে, ‘এখন সিগারেট না খেতে পারলে ভালো লাগে না। স্কুল পালিয়ে হলেও খাই। কিন্তু এসব বিষয় আমার আব্বু-আম্মু জানে না, তারা জানলে আমার সবকিছু বন্ধ করে দিবে।’
আরেক শিক্ষার্থী রাইসুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলে, ‘স্কুলের বন্ধুদের অনেকেই সিগারেট খায়। তাদের দেখে দেখে আমি সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছি। শুরুতে তেমন একটা ভালো লাগত না। অন্যান্য বন্ধুরা অনেক উৎসাহ দিত সিগারেট খাওয়ার জন্য। এখন মাঝে মাঝে বন্ধু মিলে আড্ডা দিই আর সিগারেট টানি। এতে মনে শান্তি লাগে।’
উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে তামাক আসক্তি
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সিগারেট বা তামাকে আসক্ত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা। যাদের বেশির ভাগ স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তামাকের ছোবলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের মেধা হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের দেহে বাসা বাঁধছে ক্যানসার, কার্ডিওভাস্কুলার, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ প্রাণঘাতি নানা অসংক্রামক রোগ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের তথ্যমতে, দেশে ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান ও তামাক সেবন করে। এর সঙ্গে আরও একটা অংশ রয়েছে, যারা এ গণনার বাইরে। অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এ বদভ্যাস রয়েছে, যা একটি অশনিসংকেত।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ধূমপান বা তামাকের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের ১১ কোটি ৭২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তিন কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাকজাত দ্রব্য সেবন করে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৫ দশমিক ৩ ভাগ। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বাড়িতে চার কোটি ১০ লাখ এবং গণপরিবহন ও জনসমাগমস্থলে ক্ষতির শিকার হন তিন কোটি ৮৪ লাখ মানুষ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ।

এদিকে ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২৩ সালের ডেটা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ওপরে ধূমপায়ীর সংখ্যা শতকরা ৩৯ দশমিক ১, যা ২০১৯ সালেও ছিল ৩৫ শতাংশ। এখন ছেলেদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে এ সংখ্যা ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়েদের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল ৭ শতাংশের মতো। ধূমপানে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। ধূমপানের জন্য প্রতি বছর দেশে এক লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাকে (বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা) ব্যবহারে দেহে ২৫টির বেশি প্রাণঘাতী রোগ হয়, যার মধ্যে ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যানসার অন্যতম। দেশে বছরে এক লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং কয়েক লাখ মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করে তামাকের কারণে। পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষয়ক্ষতিও অনেক বেশি।
ধূমপান রোধে যা করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিগারেটের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করে এবং ধোঁয়ামুক্ত বায়ু আইন প্রণয়ন নীতি বজায় রেখে আরও অতিরিক্ত কয়েক মিলিয়ন মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। তামাকের বিদ্যমান আইন সংশোধন ও সংযোজন করতে হবে। সেইসঙ্গে পাবলিক প্লেস, পরিবহনের আওতা বৃদ্ধি এবং এসব স্থানে সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য সেবন নিষিদ্ধ, জরিমানা বৃদ্ধি এবং আলাদাভাবে ‘ধূমপানের স্থান না’ লিখে রাখা। তামাক কোম্পানির ‘সিএসআর বা করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা’ কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য দৃষ্টির আড়ালে রাখা। খোলা ও খুচরা এবং ভ্রাম্যমাণ তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের দোকান না রাখা। তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা।
অভিযোগ রয়েছে, তামাক কোম্পানিগুলো গত ২০ বছরে বারবার আইন লঙ্ঘন করা সত্ত্বেও তাদের কোনো ধরনের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। বরং দেশের মানুষকে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত করে, সরকারের ওপর চিকিৎসার দায় বাড়িয়ে সিগারেট কোম্পানিগুলো মুনাফার পাহাড় গড়ছে। প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার দেশের বাইরে নানাভাবে পাচার করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যমান তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনে কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। যা তামাকের ভয়াবহ ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারছে না। তাই এই মৃত্যুর মিছিল কমাতে দ্রুত বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।
আসক্তদের অধিকাংশ উঠতি বয়সের
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাকের নেশায় আসক্তদের অধিকাংশই তরুণ-কিশোর বা উঠতি বয়সে ধূমপান শুরু করে। এর পেছনে তামাকজাত দ্রব্যের বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপনের প্রভাব বেশি লক্ষ্যণীয়। এক্ষেত্রে সরকারের তামাক নীতি না থাকা এবং আইন অমান্যের প্রবণতাই দায়ী। তামাক কোম্পানিগুলো আইন অমান্য করে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিক্রেতাদেরকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
নির্মূলে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘তামাক আসক্তি বাড়ায় দেশে অসংক্রামক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তামাকের ফলে ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছে। তামাক মস্তিষ্কে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দেশে তামাক উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া উচিত, এরকম জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। আমরা এর ধারে-কাছেও নেই। এখন যা হচ্ছে, তা সচেতনতার পর্যায়ে কিছু কাজ হচ্ছে। কিন্তু দেশ থেকে তামাক নির্মূলে তেমন কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘তামাক যারা উৎপাদন করে, তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান করা। সেই সঙ্গে তরুণ সমাজকে তামাকের বিকল্প দিকে উৎসাহিত করা, সেটা হতে পারে চা কিংবা কফি। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে তামাক নির্মূল করা সম্ভব।’
ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘এখন প্রচুর মুখের ক্যানসার পাওয়া যায়। যা তামাক বা পানের কারণে হয়ে থাকে। দিনে দিনে ধূমপান বা তামাকের আসক্তির সংখ্যা বাড়ছে। নারী এবং তরুণ-তরুণীরা ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছে। সেইসঙ্গে এখন অনেকেই পাবলিক প্লেসে ধূমপান করছে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশপাশে থাকা ব্যক্তিরাও। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটা গোল ঠিক করতে হবে। যাতে দিনে দিনে তামাক বা ধূমপান নির্মূল করা যায়; তামাকের বিপরীত দিকে মানুষকে নিয়ে যেতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘তরুণদের সঙ্গে খোলামেলা তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলতে হবে। বিকল্প কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা। তরুণদের সৎ পথে পরিচালনা করার জন্য উদ্যোগ রাষ্ট্র থেকেই নিতে হবে। স্কুল ও কলেজে তরুণদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে হবে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা যথাযথভাবে দিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে কোনোভাবেই তামাক, মাদক বা ধুমপান গ্রহণ করা ঠিক নয়।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লুৎফর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সিগারেটমুক্ত সমাজ গড়তে সচেতনতার বিকল্প নেই। পথে-ঘাটে, বাজারে সর্বত্র সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে তরুণ সমাজকে সিগারেটের প্রতি নিরুৎসাহ করতে হবে। তাদের ধূমপানের ক্ষতিকারক দিক ও অপকারিতা কী কী আছে, তা বোঝাতে হবে। বিশেষ করে তরুণ সমাজকে ভালোভাবে বোঝাতে হবে, যাতে তাদের মাদক বা তামাক জাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে রাখা যায়।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সিগারেট বা ধূমপানের ফলে অনেকেই মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকিসহ বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা অসংক্রামক রোগ হিসেবে পরিচিত। সেইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগে অনেকে ধুঁকে ধুঁকে মারা যান। আর যারা সিগারেট খান, বৃদ্ধ বয়সে তাদের সুস্থ থাকার সম্ভাবনাও কম থাকে।
এসএইচ/জেবি

