শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

এমবিবিএসের চার পরীক্ষাতেই প্রথম হওয়া ডা. আফিফের গল্প

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১৯ পিএম

শেয়ার করুন:

umair
ডা. উমাইর আফিফ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী উমাইর আফিফ। সম্প্রতি প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ৫৪টি মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেছেন তিনি। এর আগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষাতেও প্রথম স্থান অধিকার করেন চট্টগ্রামের এই কৃতি শিক্ষার্থী।

অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে গঠন করে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন। এই কমিশনে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পান উমাইর আফিফ। অধ্যাবসায় আর কঠোর পরিশ্রমে সর্বমহলে তিনি কুড়িয়েছেন প্রশংসা। ঢাকা মেইলের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে তার সাফল্যের নানা গল্প। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাখাওয়াত হোসাইন


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল: এমবিবিএসের চারটা প্রফেশনাল পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কী?

উমাইর আফিফ: আলহামদুলিল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার, যিনি এই তাওফিক দান করেছেন। কী সীমাহীন পরিশ্রম আর কষ্ট, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ফিফথ ইয়ার শেষ করেছি, তা আমার আল্লাহ সাক্ষী। এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে ঢাকা মেডিকেলের অসহায় রোগীদের দোয়া ও সহযোগিতার কারণে। আমার লং কেইস প্যাশেন্ট তো জীবনই দিয়ে দিলেন এবং থাইরয়েড ক্যানসারের হেনা খালা (রোগী) যিনি এখনো আমার জন্য ক্রমাগত দোয়া করেন। ফোনকলে অশ্রু ঝরান আরও অনেকেই।

আরও পড়ুন

‘মেডিকেল লাইফ কোনো ১০০ মিটার স্প্রিন্ট না, বরং ম‍্যারাথন’

এই সাফল্য কখনোই সম্ভব হতো না, যদি না সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে শেষ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলের সামির স্যার, নিপা ম্যাডাম, টিপু সুলতান স্যার, শাম্মি ম্যাডাম, রকিব স্যার, পলাশ স্যার ও আকন স্যারসহ আরও অনেক অনেক শ্রদ্ধেয় স্যার-ম্যাডামের সান্নিধ্য না পেতাম। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে ক্যাডেট কলেজের সব স্যার ম্যাডামকেও। আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া এমন সব ব্যাচমেটদের জন্য, যারা অসুস্থ হলে সেবা-যত্ন থেকে শুরু করে রাতে জেগে জেগে অনলাইন-অফলাইন ডেমো পর্যন্ত সার্বক্ষণিক পাশে থাকত। আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন। ঢাকা মেডিকেলের সাকিব, আবরার ভাইদের মতো আরও অসংখ্য সিনিয়র যারা পাশে ছিলেন, তাদেরও উত্তম প্রতিদান দিন।


বিজ্ঞাপন


Umair2
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পরিবারে বেড়ে উঠেন ডা. উমাইর আফিফ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মেডিকেলের জুনিয়র ভাইরাও যেভাবে সাপোর্ট আর দোয়া করে গেছে, আল্লাহ বাদে আর কেউ প্রতিদান দিতে পারবেন না। সর্বোপরি আল্লাহর লাখো কোটি শুকরিয়া এবং আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতার কারণে আমি এতদূর আসতে পেরেছি। অবশেষে নামের আগে ‘ডাক্তার’ শব্দটি যোগ হয়েছে।

ঢাকা মেইল: এত ভালো ফলাফল করার পেছনে কোনো অনুপ্রেরণা কাজ করেছে?

উমাইর আফিফ: অনুপ্রেরণা বলতে আমার বাবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি মসজিদের খতিব এবং বিভিন্ন ব্যাংকের শরিয়াহ্ বোর্ডের চেয়ারম্যানও। ২০০০ সালের দিকে আব্বু চট্টগ্রাম মেডিকেল হোস্টেল মসজিদের খতিব ছিলেন এবং চট্টগ্রাম ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমরা তখন চট্টগ্রাম মেডিকেলের ক্যাম্পাসে থাকতাম। ডাক্তারি পড়ার পেছনে বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন আমার আম্মু। তিনি স্বপ্ন দেখতেন আমাকে ডাক্তার বানাবেন। আর আম্মু যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীদের দেখতেন এবং চিন্তা করতেন ছেলে-মেয়েদের ডাক্তারি পড়াবেন, পরে বড় বোন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছেন এবং সেখান থেকে ডাক্তার হয়েছেন। এটাও আমার জন্য অনুপ্রেরণা ছিল।

এছাড়া আমার পরিবারে ডাক্তার রয়েছেন। কাছের মানুষেরাই আমার অনুপ্রেরণা। আমার বড় আব্বি (বড় চাচা) আর বড় আম্মি (বড় চাচি)। বড় আব্বি হলেন অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম, তিনি বাংলাদেশের বিখ্যাত নেফ্রোলজিস্টদের অন্যতম। আর বড় আম্মি হলেন বাংলাদেশের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি চিকিৎসার অন্যতম পথিকৃৎ একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতার। আমার কাছে আজীবন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন বড় আম্মি।

ঢাকা মেইল: পড়াশোনায় কোন কোন কৌশল অবলম্বন করেছেন?

উমাইর আফিফ: পঞ্চম বর্ষে ওঠার আগ পর্যন্ত রেগুলার থাকার চেষ্টা করতাম। নিয়মিত ও রুটিনভিত্তিক পড়ার চেষ্টা করতাম। আইটেমের পড়া আগেই শেষ করার চেষ্টা করতাম। কার্ডের পড়া কার্ডের আগে ভালোভাবে শেষ করা; টার্মের রেজাল্ট ভালো করা; এরকম রেগুলারিটি মেনে চলার চেষ্টা করতাম। সবসময় বুঝে পড়াশোনা করেছি। অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স করেছি। আর আপু অনেক সময় ধরে আমাকে এ টু জেড বুঝিয়ে দিতেন। এছাড়া শিক্ষকদের কাছে যেতাম পড়া বোঝার জন্য, তাদের সঙ্গে অনেক সময় ব্যয় করেছি। বন্ধুদেরও পড়াতে পছন্দ করতাম এবং কোনো কিছু বোঝার পর অন্যদেরও বোঝানোর চেষ্টা করতাম। এভাবে পড়ে আসছি।

আরও পড়ুন

‘দেশে চাকরি পাওয়ার সংগ্রামের চেয়ে বাইরে পড়াশোনা করতে যাওয়া সহজ’

ফাইনাল ইয়ারে উঠে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য হওয়ার পর আমার পড়াশোনা একটু অগোছালো হয়ে যায় এবং রেগুলারিটি মেইনটেন করতে কষ্ট হয়ে যায়। তখন অনেকটা অনিয়মিতভাবে পড়াশোনা করতে হয়েছে। দেখা গেছে, কমিশনের মিটিংয়ে গিয়েছি, সন্ধ্যায় এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে পড়তে বসেছি। পরে আবার বিশ্রাম নিয়েছি। প্রফেশাল পরীক্ষার আগ পর্যন্ত এভাবে চলেছে।

ঢাকা মেইল: এমবিবিএসে ওঠার পর কখনও ভেবেছেন এত ভালো ফলাফল করবেন?

উমাইর আফিফ: প্রথম তিনটা প্রফে প্রথম হলেও ফাইনাল প্রফে প্রথম হব একেবারেই ভাবিনি। তবে ঢাকা মেডিকেলের ব্যাচমেট-সিনিয়র ভাই, জুনিয়র ভাই, স্যার-ম্যাডামরা প্রায়ই বলতেন- তুই ফার্স্ট হবি, তোর জন্য অনেক দোয়া ইত্যাদি। এক্সপেক্টেশনের একটা প্রেশার ছিল। এখন যা হয়েছে, তাতে আলহামদুলিল্লাহ্।

ঢাকা মেইল: কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চান এবং কেন?

উমাইর আফিফ: এখনো ঠিক করিনি। তবে নিউরোলজি আমার সবসময়ের পছন্দের সাবজেক্ট। ইন্টার্ন করার সময় ঘুরে ঘুরে সব দেখার ইচ্ছা, তারপর সিদ্ধান্ত নেব কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চাই।

Umair3
মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে চান তরুণ এই চিকিৎসক। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মেইল: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।

উমাইর আফিফ: আমার চিন্তা সবসময় ছিল ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক। কিন্তু কমিশনে কাজ পাওয়ার পর আমি ভেবে দেখেছি, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে পলিসি লেভেলে কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে। সেটা মেডিকেল এডুকেশন হতে পারে। হসপিটাল সার্ভিস, গভার্নেন্স হতে পারে। স্বাস্থ্যখাতে এখনো অনেক কাজ বাকি এবং কাজ করা দরকার। আমি মনে করি, পলিসি লেভেলে চিকিৎসকদের আরও অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। সেই দিক থেকে ক্যারিয়ারের বাইরে গিয়েও দেশের মানুষের জন্য পলিসি লেভেলে কাজ করার ইচ্ছা আছে।

আরও পড়ুন

‘জুনিয়র কনসালটেন্ট’ পদবি নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা

ঢাকা মেইল: জুনিয়রদের জন্য কী কী পরামর্শ দেবেন?

উমাইর আফিফ: মেডিকেলের একজন ভাই একবার আমাকে বলেছিলেন, মেডিকেল কোনো স্প্রিন্ট না, এটা হলো একটা ম্যারা্থনের মতো। লেগে থাকতে হয়। অনেক বাধা বিপত্তি আসবে, কিন্তু কখনোই হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আমিও বলব এটাই। দিনশেষে অন্যান্য শিক্ষার সাথে মেডিকেলের তফাতটা হলো, আমাদের এটার সাথে মানুষের জীবন সরাসরি সম্পর্কিত। তাই রেস্পন্সিবিলিটির জায়গাটা অনেক অনেক বেশি। এছাড়া আমাদের মধ্যে পরস্পর সহমর্মিতার চর্চা থাকাটাও খুব জরুরি। যেহেতু প্রায়ই দেখা যায়, মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা অনেক অনেক হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দিনশেষে দেশ সমাজ ও মানুষের জন্য কাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের জীবনের সবার লক্ষ হওয়া উচিত। আর মেডিকেল আমাকে সেই সুযোগটা দিচ্ছে বেশ সহজভাবেই।

ঢাকা মেইল: আপনার বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই।

উমাইর আফিফ: আমার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, ক্লাস সেভেনে থেকে এসএইচসি পর্যন্ত ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। এরপর এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধা তালিকায় ৫২তম স্থান অর্জন করি।

ঢাকা মেইল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

উমাইর আফিফ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর