রোববার, ১৬ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদ নির্বাচন, কী বার্তা দিচ্ছে নতুন দল

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১ মার্চ ২০২৫, ১১:০৯ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img
জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ।

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি’র বক্তব্য ও ঘোষণা নিয়ে রাজনীতিতে নানা সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছে।

শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) জন্ম নেওয়া দলটি কোনো দর্শন ও সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি নিয়ে হাজির হতে পারেনি- এমনটাও মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।


বিজ্ঞাপন


অন্যদিকে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, সেকেন্ড রিপাবলিক এবং দলটির স্লোগান ইনকিলাব জিন্দাবাদ; এগুলো বলে দলটি কী বলতে চেয়েছে কিংবা ভবিষ্যতে কী করতে চাইছে তা নিয়েও জনমনে উঠেছে নানা প্রশ্ন।

দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, আমরা যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলেছি; তাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টে দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে।

 তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোতেই স্বৈরাচার তৈরির সুযোগ আছে। রাষ্ট্রের মতো অনেক দলেও তাই সর্বময় ক্ষমতা একজনের হাতে চলে যাচ্ছে। আবার দেখুন গত পনের বছরে যেসব আন্দোলন গড়ে উঠেছে তা কিন্তু তরুণরা করেছে। ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সিস্টেম ভাঙা এবং তরুণদের প্রত্যাশা পূরণের বার্তাই আমরা দিয়েছি।

যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, দলটি মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী একটি মধ্যবিত্তের দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আভাস দিয়েছে, যাতে প্রথাগত রাজনৈতিক পরিবর্তনের বার্তা আছে। কিন্তু এটি করতে দেশে যে রাজনৈতিক ঐক্য দরকার হবে তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা তারা দিতে পারেনি।


বিজ্ঞাপন


অন্যদিকে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, যারা সেকেন্ড রিপাবলিকের ঘোষণা দিয়েছেন; সেটা তাদের ঘোষণাপত্রে থাক। যারা গণপরিষদের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে চান; সেটা তারা যখন পারবেন করবেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের আর কোনো বিলম্ব যেন না হয় সেজন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই আমাদের আহ্বান।

অর্থাৎ সেকেন্ড রিপাবলিক কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি সংসদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করার একটি বার্তা হিসেবে মনে করার একটি ইঙ্গিত বিএনপির দিক থেকে আসছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন নতুন দলটি তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা বলেছে, যা তাদের সাধারণ অধিকার। তবে দেখার বিষয় হবে লক্ষ্য অর্জনে তারা কী ধরনের কর্মপন্থা বেছে নেয়।

NCP2

ঘোষণায় যা বলেছে এনসিপি

শুক্রবার ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তৃতায় বার বার উঠে এসেছে একটি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বা ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার বিষয়।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদেরকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।

সেকেন্ড রিপাবলিক ধারণাটি মূূলত তৈরি হয়েছে ফরাসি বিপ্লব থেকে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, কোনো দেশে আগের শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে নতুন শাসনকাঠামো বা ব্যবস্থাপনার ভিত্তি স্থাপন করা। বিপ্লব বা অভ্যুত্থানসহ নানাভাবে এরকম পরিবর্তন আসতে পারে।

ওই অনুষ্ঠানে দলের শীর্ষ নেতারা যেসব স্লোগান দিয়েছেন তার মধ্যে ‘ইনকিলাব ইনকিলাব, ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটিই অনেকের নজরে এসেছে। অবশ্য আরিফুল ইসলাম আদিব বলেছেন, তাদের দলীয় স্লোগান এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

আদিব বলেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ এবারের গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রবল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষ জেগে উঠেছিল। সে জায়গা থেকেই এটি এসেছে। তবে আমাদের দলীয় স্লোগান, গঠনতন্ত্র, কর্মসূচি ও পতাকা আমরা এখনও চূড়ান্ত করিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ মূলত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির স্লোগান ছিলো। এখানে এটি নতুন। অনেকের কাছে পীড়াদায়ক হলেও আমি এটাকে নেতিবাচক দিক থেকে দেখি না। এটি বিপ্লব বা পরিবর্তনের স্লোগান।

নতুন দলের বার্তা সম্বন্ধে বিশ্লেষকদের মত

সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদের নির্বাচনের বিষয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা শুধু একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। বরং জনগণ রাষ্ট্রের ওপর আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল; যাতে করে জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়।

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল যে দ্রুত নির্বাচনের দাবি করে আসছে কৌশলে তা নিয়েও কিছু বার্তা দিয়েছে নবগঠিত দলটির নেতারা। সেজন্যই দলটি ‘নতুন স্বাধীনতা একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি’ বলে উল্লেখ করেছে।

আবার সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে সাধারণত আগের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন শাসন কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা গড়ে তোলাকে বোঝানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি করতে হলে বিএনপিসহ সব দলের মধ্যে ঐক্য তৈরি করা ছাড়া অসম্ভব বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গণপরিষদ মানে হলো নতুন সংবিধান করা হবে। অর্থাৎ সামনে যে নির্বাচন হবে তাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গণপরিষদ সদস্য হিসেবে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন। ওই গণপরিষদই আবার পার্লামেন্ট হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য দরকার সেটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমি নিকট ভবিষ্যতে দেখি না।

প্রসঙ্গত, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ইতোমধ্যেই নতুন করে সংবিধান লেখার ধারণার বিরোধিতা করে পার্লামেন্টে আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার পক্ষপাতী। এর আগেও নতুন সংবিধান নিয়ে বিতর্ক হয়েছে কিন্তু বিএনপি তাতে সায় দেয়নি।

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের কথা এসেছে। সেকেন্ড রিপাবলিকের চিন্তা থেকেই বিদ্যমান সংবিধান বাতিলের বিষয়টি এসেছে।

তিনি আরও বলেন, এটি সত্য যে বর্তমানের সংবিধান গণতন্ত্র চর্চার জন্য উপযোগী নয়। এ অবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার কথা বলা যায়। কিন্তু দেশে এখন যারা দ্রুত নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকার চায় তাদের সাথে এ নিয়ে সংকট তৈরি হওয়ার আভাস আছে। এগুলো করতে হলে অন্য সব দলকে নিয়েই সেটা করতে হবে। সেখানে রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপার রয়েছে।

এর বাইরে নতুন রাজনৈতিক দলটি তাদের বক্তব্য ও অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেনি বলেও অনেকে মনে করেন। বরং দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ যারাই বক্তব্য দিয়েছেন তাদের বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের চিন্তাধারার বিরোধিতা যতটা প্রকট হয়ে এসেছে; দলটি কীভাবে এগুবে সেই বিষয়ে ততটা গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়নি।

এর ফলে আওয়ামী লীগ বিরোধিতা ও ভারত বিরোধিতার মতো ইস্যুগুলো নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের যে অবস্থান, নতুন দলটিও সেই একই ধাঁচে তৈরি হওয়ার একটি বার্তা দিয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে।

আবার কেউ কেউ মনে করেন দলটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি চূড়ান্ত হলেই মূলত এর বৈশিষ্ট্য ও দেশবাসীর প্রতি তাদের বার্তা পরিষ্কার হবে।

গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের বার্তা কিংবা অবস্থান পরিষ্কার। কিন্তু তারা নতুন কী করবে সেটা বলতে পারেন নি। দলটিতে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মতের সমাবেশ আছে। তাদের একটা জায়গায় এনে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করার পর বোঝা যাবে যে তারা আসলে কী বার্তা দিতে চাইছে।

তার মতে নতুন দলটি নতুন বাংলাদেশ বলতে নতুন কী কী ব্যবস্থা করতে চায় এবং অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ধর্মমতে সমষ্টির বিষয়ে কী বলে সেটি এখনও অস্পষ্ট।

কেউ কেউ মনে করেন সেকেন্ড রিপাবলিক কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের জায়গায় ২০২৪-কে প্রতিস্থাপনের একটি চেষ্টাও নতুন দলটির কোনো কোনো অংশের থাকতে পারে। যদিও দলটির নেতারা আগেও বলেছেন যে একাত্তরকে মূল ভিত্তি রেখেই তারা চব্বিশের চেতনায় নতুন বাংলাদেশ গড়তে চান।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন দলটি আরও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসবে বলে আশা করেছিলাম।

তিনি আরও বলেন, তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী সব দলকে ডেকেছে। দেখে মনে হয় একটা সমন্বয়ের রাজনীতির বার্তা আছে। কিন্তু এদের মধ্যে কেউ গণতন্ত্র, কেউ সমাজতন্ত্র, আবার কেউ কেউ খিলাফত চায়। এসব বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট দেখছি না।

তার মতে নতুন দলটি তাদের আসল রাজনীতি স্পষ্ট করতে পারেনি এবং তারা মুখে মধ্যপন্থার কথা বললেও তাদের কর্মসূচি আসলেই তার প্রতিফলন দেখা যাবে।

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, দলটি যতটা সামনে এগুতে চাইবে ততই তাদের রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

আরেকজন বিশ্লেষক ও নয়া দিগন্তের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবর বলেন, কিছু ইস্যুতে বক্তব্যের ভিন্নতা দিয়ে তারা একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বার্তা দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এটি সত্যিই তারা বিশ্বাস করলে সেটি তাদের সামনের পদক্ষেপে দেখা যাবে। তবে প্রথম দিনে আরও স্পষ্ট বক্তব্য ও কর্মসূচি আসলে মানুষের কাছে পরিষ্কার বার্তা যেত যে দলটি আসলে কোন লক্ষ্য কীভাবে অর্জন করতে চায়।

তার মতে এ মুহূর্তে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থায় নতুন দলটি না থাকলেও একটি প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠার মতো নতুনত্ব দলটিতে আছে বলে মনে হচ্ছে। তবে এখনো অনেক ধোঁয়াশা আছে। সামনে এগুলো তাদের পরিষ্কার করতে হবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা

/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর